ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রবাসী রেমিট্যান্স-পোশাক রপ্তানি

চাপ কমছে অর্থনীতিতে

চাপ কমছে অর্থনীতিতে

বিশ্বে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। এই ঈদকে সামনে রেখে ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের আর্থিক খাতে গতি সঞ্চারে পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বরাবরের মতো ঈদুল ফিতর গুরুত্ব বাড়ায়। প্রতিবছর এই সময় চাঙা হয় দেশের অর্থনীতি। বাজারে বাড়ে টাকার প্রবাহ।

জানা গেছে, ধর্মীয় উৎসব ঘিরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পাশাপাশি অর্থের বড় জোগান আসে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস। গতিশীল হয় অভ্যন্তরীণ বাজার, জাকাত ও ফিতরা থেকে। অন্যতম একটি উৎস রেমিট্যান্সও। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ঈদ কেন্দ্র করে পরিকল্পনা সাজায়। প্রতিবছর দেড় থেকে ২ লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়। প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি বিদেশে পোশাক রপ্তানির গতি বেড়ে যায়। এবারও প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে গতি ফিরছে। ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী রেমিট্যান্স আনতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ডলার-সংকটের এ সময়ে প্রবাসী রেমিট্যান্স ও পোশাক রপ্তানি দুটোই গতি ফিরছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ৫১৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল আর প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ। চলতি মাসে রপ্তানি আয় আরো বাড়তে পারে। সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে ঈদুল ফিতরে প্রবাসীদের আয়ে সুখবর আসবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ৩ হাজার ২৮৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ১ হাজার ৬২৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। তবু মার্চে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা জানতে আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দেশে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ঈদ কেন্দ্রীক অর্থনীতির আকার ব্যাপক। এই উৎসবের দিনে প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটাতে ঘুরমুখো হয় বেশিরভাগ মানুষ। আত্মীয়-স্বজনদের মুখে হাসি ফুটাতে প্রবাসীরা নিজের অর্জিত সব অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বোনাস, ভাতার মতো অর্থপ্রাপ্তি, লেনদেনের মাধ্যমে রসদ যোগাবে গ্রামীণ আর শহুরে অর্থনীতিতে। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে ঈদুল ফিতরে লেনদেন সন্তোষজনক পর্যায়ে আসবে। ঈদকে সামনে রেখে রেকর্ড গতিতে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোগ হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি শেষে রেমিট্যান্স এসেছে ২১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, আগের বছরের একই মাসের চেয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৮ শতাংশ। গত ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ডলার এসেছিল দেশে। ওই সময় দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। রোজা, ঈদ, বাংলা নববর্ষকে ঘিরে প্রবাসীরা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠায়। এবার মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোজা শুরু হয়েছে। এপ্রিলের ১১-১২ তারিখে হবে ঈদ। এতে চলতি মাসের পাশাপাশি আগামী মাসেও রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরো বাড়তে পারে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বৈদেশিক মুদ্রা যোগানের ক্ষেত্রে বছরে পর বছর প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। এবার প্রবাসীদের কল্যাণে নজর দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। প্রবাসী ও রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সমস্যা সমাধানে শিগগিরই প্রবাসী কল্যাণ সেল গঠন হবে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান। গত বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতীয় পর্যায়ে, বিভাগীয় পর্যায়ে, জেলা পর্যায়ে ও উপজেলা পর্যায়ে পৃথক পৃথক কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ সেল প্রবাসীদের সমস্যা তড়িৎগতিতে সমাধানে সর্বদা তৎপর থাকবে।

প্রবাসী রেমিট্যান্স, পণ্য রপ্তানির সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও লেনদেন বেড়েছে। মৌচাক মার্কেটের শান ফ্যাশন হাউজের স্বত্বাধিকারী আবু সফিয়ানা বলেন, ঈদের বাজার এখনো পুরোপুরি জমে ওঠেনি। আগামী সপ্তাহের দিকে বাজার জমে উঠবে। মার্কেটে বিভিন্ন দামের নানা ক্যাটাগরির শাড়ি, সার্ট, প্যান্ট ও জুতা রয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন-রিজার্ভও ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। এটা একটি বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছানোর উপক্রম হয়েছে। তবে প্রত্যেক বছরের মতো এবারের ঈদেও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে, এটি স্বাভাবিক। কারণ উৎসবের কেনাকাটায় দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা ডলারের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় অর্থনীতির অনিবার্য ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বিনিময় হারের পার্থক্য ও ব্যাংকের প্রতি অনাস্থার কারণে অনেকেই হুন্ডিতে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন।

অন্যদিকে গত শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ থেকে সব মিলিয়ে ৯৪৭ কোটি মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। এর আগের ছয় মাস তৈরি পোশাকের রপ্তানি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে রপ্তানি পুনরুদ্ধার শুরু হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমাদের প্রধান বাজার, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ হলিডে সেলসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছিলাম, ২০২৪ সালে খুচরা ব্যবসা ফিরে আসার ইঙ্গিত আছে।’ ফারুক হাসান জানান, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ৪৮৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। যদিও ইইউর মধ্যে বড় বাজার জার্মানিতে কয়েক মাস ধরেই পোশাক রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে ফ্রান্স, স্পেন ও ইতালিতে রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় আছে।

এদিকে এককভাবে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রেও তৈরি পোশাক রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে বলে জানান বিজিএমইএর সভাপতি। তিনি বলেন, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৪৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। একইভাবে কানাডা ও যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাকের রপ্তানি যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৯ ও ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত