যেসব মৌলিক বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণকে ঈমান বলা হয় তার অনিবার্য অনুষঙ্গ আখেরাত বা পরকালে বিশ্বাস। মুসলমান মাত্রই পরকালে বিশ্বাস করে। আমরা যে জগতে বসবাস করছি তা একদিন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহর সম্মানিত ফেরেশতা ইসরাফিল (আ.) প্রথমবার সিঙ্গায় ফুঁক দেবেন, তখন সমগ্র সৃষ্টিজগত লন্ডভন্ড তছনছ হয়ে যাবে। মহাপ্রলয় সংঘটিত হবে, সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আকাশ পৃথিবীর কোথাও। সবকিছু নাই অবস্থায় সুদীর্ঘ একটি সময় অতিবাহিত হবে।
আল্লাহর হুকুমে ইসরাফিল (আ.) দ্বিতীয়বার সিঙ্গায় ফুঁক দিবেন। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপে মৃতবৎ পৃথিবী বসন্তের আগমনে, যেভাবে পুনরায় জেগে ওঠে, সেভাবে ইসরাফিলের ফুঁকে সবকিছু পুনরায় জীবন লাভ করবে। তারপর অনুষ্ঠিত হবে হাশরের ময়দান মহাসমাবেশ। সৃষ্টির শুরু হতে মহাপ্রলয় পর্যন্ত পৃথিবীতে বসবাসকারী সব মানুষ হাশরের মাঠে উপস্থিত হবে। আগে যত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল তারা এতদিন ছিল কবর জগতে। টিবির ভেতর থেকে উই পোকা বের হওয়ার মতো মানুষরা কবর ফুঁড়ে বের হবে, সমবেত হবে মহাসমাবেশ হাশরে।
মানুষের সৎকর্ম অসৎকর্ম ওজন দেয়ার মীজান (পাল্লা) স্থাপিত হবে। এরপর জাহান্নামের পিঠের উপর স্থাপিত সুদীর্ঘ উড়াল সেতু পার হতে হবে প্রত্যেককে। ঈমানদার সৎকর্মশীলরা ধীর কিংবা ক্ষিপ্রগতিতে সে সেতু পার হয়ে যাবে। তাদের শেষ গন্তব্য চিরসুখের আবাসিক এলাকা জান্নাত কানন। কাফের বদকাররা ক্ষুরের চেয়ে ধারালো চুলের চেয়ে সূক্ষ্ম সেতু পার হতে গিয়ে কাটা পড়ে কিংবা পা পিছলে দোযখে পড়ে যাবে। এই হল পরকাল। পরকালে বিশ্বাস ঈমানের অনিবার্য শর্ত। পরকালের ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ থাকলে কেউ মুসলমান হিসেবে গণ্য হবে না।
অমুসলিমরা স্বর্গ নরকে বিশ্বাসের কথা বললেও মনগড়া কিছু ভ্রান্ত ধারনায় আক্রান্ত। দুনিয়াতে সৎকর্মের বদলায় পরজীবনে পুণ্যবান মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করবে আর মন্দ কাজের প্রায়শ্চিত্য হিসেবে পরজন্মে শুকর কুকুর হয়ে জন্ম নেবে পুনর্জন্মবাদের এমন বক্তব্য যুক্তির মাপকাঠিতে টিকে না, স্বর্গ ও নরকের আলাদা অস্তিত্বে বিশ্বাসের সাথে খাপ খায় না।
অতীতের রূহের জগত; এমনকি মাতৃগর্ভে মানব শিশুর যাপিত জীবনের স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান পান্ডিত্য খরচা করে আমরা তেমন কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারি না। তেমনি মৃত্যুর পর কবর জীবন এবং তারপর অনন্তকাল আখেরাতের বেলায়ও আমাদের জ্ঞানবুদ্ধি পরাস্ত। এ সম্পর্কে মানব জ্ঞানের একমাত্র সম্বল আল্লাহ ও রাসূলের বর্ণনা। কুরআন ও হাদীসে যতকথা বলা হয়েছে সব যেহেতু সত্য ও যুক্তির মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ সেহেতু কবর ও হাশর সম্বন্ধেও কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা সন্দেহাতীত সত্য।
যারা আল্লাহ ও রাসূলকে বিশ্বাস করে না তারা আখেরাতকে বিশ্বাস করে না। তাদের কথা, আমরা কি মৃত্যুর পর, মটির সাথে মিশে ধূলোবালিতে পরিণত হওয়ার পর পুনরায় জীবন লাভ করব। তা সম্ভব নয়। আমরা তা বিশ্বাস করব না। তাদের বক্তব্য খন্ডন করে অকাট্য যুক্তি দেয়া হয়েছে কুরআন মজীদের অসংখ্য সূরা ও আয়াতে। মুুমিনরা কুরআন ও হাদিসের সে বর্ণনাকে বিশ্বাস করে। ফলে আখেরাতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের তারতম্য থেকে মুসলিম ও কাফেরের জীবন দর্শনে বিরাট পার্থক্য দেখা দেয়।
কাফের মনে করে এই জগতই শেষ। কাজেই যত পার দুনিয়াকে ভোগ করে নাও। এই জীবনের পর আর কোনো জীবন নাই। এখানে কিসে তোমার লাভ বা অলাভ সেটিই ন্যায় অন্যায়ের মানদন্ড। মুমিন বলে, এই জগতই সবকিছু নয়। এখানে ভালো লোক আছে, মন্দ লোক আছে। অনেক ক্ষেত্রে মন্দরা ভালোদের উপর প্রতাপ চালাচ্ছে। জালিমরা দুর্বলদের উপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। যুক্তি ও নৈতিকতার দাবি হচ্ছে, সত্যের জয় ও মিথ্যার পরাজয়ের জন্য একটি জায়গা থাকতে হবে। সেই জায়গা হল আখেরাত। দুনিয়াতে মানুষ ভালো বা মন্দ কাজের যে বীজ বপন করে তার ফল ফসল তুলবে পরকালে। কাজেই প্রত্যেকের জীবনযাত্রা পরিচালিত হতে হবে সত্য, ন্যায় ও সততার উপর। পরকালেই প্রত্যেকে তার কর্মের চূড়ান্ত ফলাফল লাভ করবে।
পার্থিব এই জগতই যদি একমাত্র জগত হয়, এরপর যদি ভালো বা মন্দের উপযুক্ত প্রতিদানের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সৎলোকেরা তাদের প্রকৃত প্রতিদান কোথায় পাবে কিংবা অসৎ লোক যারা দুনিয়াতে জুলুম অত্যাচার করেছে তারা শাস্তি কোথায় পাবে। এইটুকুন সত্য ও যুক্তি যারা মানে না, তার কিছুতেই মানুষরূপে গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়। কেননা, তারা প্রকৃতপক্ষে অন্যায়কারী, অত্যাচারী ও পাপিদের পক্ষ নেয়। জোর যার মুল্লুক তার দর্শনের পক্ষে কথা বলে। এরা মনের দিক দিয়ে জালিম। কারণ, জালিম ও জুলুমের মতাদর্শকে সমর্থন করে। তাদের জীবন দর্শন ‘দুনিয়াকা মজা লে লও দুনিয়া তোমারী হ্যায়।’ আজকের দুনিয়ায় সেই মতবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ চলছে।
পক্ষান্তরে মুমিন মাত্রই পরকালে বিশ্বাসী। তাই তার কাজকর্ম হয় আখেরাতমুখি। আখেরাতে বিশ্বাসী বলেই সে অন্যায় করতে পারে না। পরকালে বেহেশতের পরম সুখের আশা ও দোযখের কঠিন শাস্তির ভয় আছে বলেই সে রোজা রাখে, একটা মাস সিয়াম সাধনা করে। মহাপ্রলয় ও তার পরবর্তী জীবনের সত্যতার সামান্য ঝলক ফুঠে উঠেছে সূরা আল-কারিআয়। আল্লাহ পাক বলেন-
‘মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কী? মহাপ্রলয় সম্বন্ধে আপনি কী জানেন? সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মত। এবং পর্বতসমূহ হবে ধূনিত রঙ্গিন পশমের মত। তখন যার পাল্লা ভারী হবে সে তো লাভ করবে সন্তোষজনক জীবন। কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে তার স্থান হবে হাবিয়া। আপনি কি জানেন তা (হাবিয়া) কী? তা হল উত্তপ্ত আগ্নি। (সূরা আল-কারিআ)