ঘন ঘন আগুনে বাড়ছে ভীতি

* ত্রুটিপূর্ণ কাঠামোতে অগ্নিঝুঁকি * পানির স্বল্পতায় বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি * তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ উপেক্ষিত

প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীসহ সারা দেশে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এতে মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কয়েকগুণ বেড়েছে। গতকালও গুলশান এক নম্বরে সিয়েলো রেস্টুরেন্ট ভবনের ৯ তলায় আগুন লেগেছিল। ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের আধাঘণ্টায় চেষ্টায় আগুন নেভাতে পেরেছে। আগুন ছড়িয়ে পড়লে গুলশানের মতো ব্যস্ততম এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।

জানা গেছে, চলতি বছরে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রাজধানীর বেইলি রোডে। ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু ঘটে এবং গুরুতর আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২২ জন। ভবনের ভেতরে বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। সেগুলোতে আগুন ধরে যাওয়ায় লোকজন বের হতে পারেননি। আগুন ধরার কিছু সময় পর এক এক করে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। ভবনের পুরো ভেতরটা ধোঁয়ায় ঘেরা ছিল বাইরেও ধোঁয়া বেরিয়ে আসছিল। বিভীষিকার রাত দেখে মানুষ। বেইলি রোডের আগুনের ঘটনার রেষ শেষ হতে না হতেই চট্টগ্রামে এস আলম সুগারমিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে আগুন নেভার আগেই আরও কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সদরঘাট থানাধীন স্ট্র্যান্ড রোড বাংলাবাজার এলাকা এবং চকবাজারে আগুনে লাগে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সিলিন্ডারের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসে আগুন লেগে দগ্ধ হয়ে ১৪ জন মারা যায়। গত বুধবার রাজধানীর মালিবাগে রেস্তোরাঁর সিলিন্ডার থেকে আগুনের ঘটনায় দগ্ধ চারজনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডেমরার ভাঙ্গা প্রেস এলাকার গুদামটিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ৮ ঘণ্টা চেষ্টায় আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হয়। সর্বশেষ গতকাল রাজধানীর গুলশান ১ নম্বরে সিয়েলো রেস্টুরেন্টের ভবনে আগুন লেগেছে। এভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, দেশে গত বছর দৈনিক গড়ে ৭৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আগুনে নিহত হয়েছেন ১০২ জন ও আহত হয়েছেন ২৮১ জন। আগুনে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। সারা দেশে আহত ২৮১ জনের মধ্যে পুরুষ ২২১ ও নারী ৬০ জন এবং নিহত ১০২ জনের মধ্যে ৭৩ জন পুরুষ ও ২৯ জন নারী। সম্পদের ক্ষতি হয় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসে ৪৮ কর্মী আহত হয়।

বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগে ৯ হাজার ৮১৩টি, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ৪ হাজার ৯০৬টি, চুলা থেকে ৪ হাজার ১১৭টি। এ ছাড়া ছোটদের আগুন নিয়ে খেলার কারণে ৯২৩টি, গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে ৭৭০টি, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ১২৫টি এবং বাজি পোড়ানো থেকে ৮৭টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বাসাবাড়ি বা আবাসিক ভবনে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে।

জানা গেছে, আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। রাজধানীতে যতবারই বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ততবারই আলোচনায় আসে আগুন নেভানোর জন্য পানির উৎস নিয়ে। কিছুদিন পর সব আলোচনা থেমে যায়। বিভিন্ন আইন ও নীতিতে পরিবেশবান্ধব নগরীতে পুকুর, জলাধার কী পরিমাণে থাকতে হবে, করণীয় কী, তার নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে পুকুর ও জলাধার ভরাটের মহোৎসব চলছেই। প্রাকৃতিক জলাশয় সংরক্ষণ আইনসহ বিভিন্ন আইন থাকার পরও জলাশয় কমতে কমতে কেন্দ্রীয় ঢাকায় ৫ থেকে ৬ ভাগে নেমেছে।

রাজধানীজুড়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ১৭টি সুপারিশ করেছিল। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কোনো সংস্থার নজর নেই। ফলে ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন বা আলোর মুখ দেখেনি। প্রতি বছরই বড় ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম বা কারখানা সরিয়ে নেয়া, অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ, বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া জোরদার করা, ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিন গিয়ে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিকজাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দফতরের পরিবর্তে সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচিতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা প্রভৃতি। দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটা সময় তৈরি পোশাক কারখানা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে ছিল। এখন বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগুনের ঘটনা ঘটছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ফায়ার নিরাপত্তায় কেউ টাকা খরচ করতে চান না। ১০ বছর আগে কেউ বিদ্যুতের কাজ করিয়েছেন, সেটা এখন কী অবস্থায় রয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখা হয় না। অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মানুষের উদাসীনতা রয়েছে। সচেতনতা বাড়লে আগুনের ঘটনা কমানো সম্ভব।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেছেন, নিরাপত্তা বিধিমালার দুর্বল প্রয়োগে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সরকারি সংস্থাগুলো নিরাপত্তা বিধি প্রয়োগে আন্তরিক নয়। এছাড়াও যেসব ভবন ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মাণ হয়েছে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ায় সেসব ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আদিল মোহাম্মদ খান আরও বলেন, অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা না মেনে অপরিকল্পিত নির্মাণ প্রকল্প অনেক সময় এমন ট্র্যাজেডির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অমান্যকারীদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া উচিত এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।