ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তকদিরে বিশ্বাসে শান্তির ছায়া

তকদিরে বিশ্বাসে শান্তির ছায়া

তকদির মানে ভাগ্যলিপি। মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত তকদিরে বিশ্বাস। ‘ওয়াল কাদরে খাইরিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লাহ’- জীবনে ভালো বা মন্দ যা কিছু ঘটে, আল্লাহর নির্ধারিত তকদিরের লিখন অনুযায়ী ঘটে- এ কথায় সন্দেহাতীত বিশ্বাস না থাকলে কেউ মুসলমান হতে পারবে না। আমি আপনি যা যা করছি বা ভবিষ্যতে করব সব তকদিরে ভাগ্যলিপিতে লেখা আছে। সেই লিখনের বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারো নেই।

প্রশ্ন আসে- তাহলে মানুষের চেষ্টা পরিশ্রমের কী মূল্য আছে। এই প্রশ্নকে সামনে রেখে মানব সভ্যতায় দুটি মতাদর্শের দোর্দণ্ড প্রতাপ চলছে। একটি মতবাদ হলো মানুষের কোনো কর্মক্ষমতা নেই। মানুষ রোবট। বিধাতা যেভাবে চলার জন্য সূইচ টিপে রেখেছেন সেভাবেই চলছে। এর বাইরে কিছুই হচ্ছে না। ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কী দোষ’। মানুষ হল পুতুল। সে ভালো বা মন্দ যাই করুক, পাপ পুণ্য যত কর্ম সে করছে নিজের ইচ্ছায় করছে না। সব বিধাতার ইচ্ছা। কাজেই তার সওয়াব গুনাহ হবে কেন। পুরস্কারস্বরূপ বেহেশত বা শাস্তি স্বরূপ দোজখে যাওয়ার কথা কেন বলা হবে। আল্লাহর হুকুম ছাড়া ধুলা ওড়ে না, গাছের পাতা নড়ে না। বান্দার করার কিছুই নেই। তকদিরে বিশ্বাসের এই ব্যাখ্যা আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনকে দারুণভাবে আক্রান্ত করেছে যুগে যুগে। এখনো যারা ঘরবাড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে আল্লাহর রাস্তায় মেহনতে বেরিয়ে যান তারাও প্রকারান্তরে এই মতবাদের অনুসারী।

আরেকটি মতবাদ দুনিয়ামুখি। এই জগতে মানুষই সত্য। মানুষ যা চায় তা অর্জন করতে পারে। চেষ্টা ও সাধনার বিকল্প নেই। তকদির বা ভাগ্যলিপির প্রশ্ন অবান্তর। তাদের জীবন দর্শন ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতার শূন্য থাক’।

উভয় মতবাদের পক্ষে কুরআন ও হাদিস থেকেও যুক্তি আনা যায়। ‘আল্লাহ যা চান সেটিই তোমাদের চাওয়া, সেটিই তোমাদের পাওয়া’। ‘মানুষ যার জন্য চেষ্টা করে সে সেটিই পায়’। বাহ্যত পরস্পর বিপরীত উপরোক্ত দুটি বক্তব্য কুরআন মজিদের।

এখন আমি কোনটি গ্রহণ করব? তকদিরের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার পর স্বয়ং সাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও প্রশ্নটি জেগেছিল। বুখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত এক হাদিসে বিষয়টি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে-

‘হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন : তোমাদের মধ্যে এমন কোনো লোক নেই যার বাসস্থান হিসেবে জাহান্নাম অথবা জান্নাত লিপিবদ্ধ করা হয়নি। তখন সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন : হে আল্লাহ্র রাসূল! তা হলে কী আমরা সে (অদৃষ্টের) লেখার ওপর নির্ভর করে আমাদের সকল প্রকার আমল ছেড়ে দেব না?

রাসূল (সা) বললেন : না, তোমরা আমল করতে থাক। কেননা, প্রত্যেক লোকের জন্য সেটিই সহজ করে দেয়া হয়, যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যে পুণ্যবান তার জন্য নেক কাজ করা সহজ হয়ে যায়। আর যে লোক পাপী বা বদবখত, তার জন্য পাপের কাজ করাই সহজ হয়ে যায়। অতপর নবী করীম (সা) প্রমাণ স্বরূপ কুরআন মজীদের এ আয়াত পাঠ করলেন-

‘সুতরাং, কেউ দান করলে, মুত্তাকী হলে এবং যা উত্তম তা সত্য বলে গ্রহণ করলে- আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ।’ - (সূরা লায়ল, আয়াত-৫-৭)

বুঝা গেল, তকদিরে বিশ্বাস মানে অকর্মণ্য অকেজো হয়ে পড়ে থাকা নয়, বরং সংগ্রাম-সাধনা, জিহাদ ও কর্মময় জীবন তকদিরের ফায়সালার অন্তর্ভুক্ত। এই পথে অগ্রসর হলেই তকদির বা ভাগ্যলিপির অজানা সত্যগুলো প্রকাশিত হবে মানুষের জীবনে।

কাজেই আমি তকদিরে বিশ্বাস করি, আমার সব কাজ আল্লাহ করে দিবেন একথা বলে অতি ধার্মিক সাজার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ মানুষকে হাত পা দিয়েছেন, কর্মক্ষমতায় সজ্জিত করেছেন তার অর্থ হল মানুষকে চেষ্টা করতে হবে। সাধনা করতে হবে। চেষ্টা ও সাধনার মাধ্যমে ভাগ্যলিপিতে কি আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। যদি দেখা যায় শত চেষ্টার পরও কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পাওয়া যায় নি; মনে করতে হবে আমার তকদিরে নাই। তাই পাইনি। একটি চেয়েছিলাম, তার বদলায় যা পেয়েছি তাই আমার তকদিরে লেখা ছিল এবং সেটিই আমার জন্য উত্তম। সে বিশ্বাস করে ‘তোমরা যা অপছন্দ কর সম্ভবত তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা ভালোবাস সম্ভবত তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ জানেন তোমরা জান না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৬)

এই চিন্তা ও বিশ্বাস থেকে তকদিরে বিশ্বাসী মুমিনের মন পরম শান্তিতে ভরে যায়। সে বলে, আমার চেষ্টা আমি করেছি। তার ফল আল্লাহ এভাবে দিয়েছেন, এর মধ্যেই আমার কল্যাণ।

যারা তকদিরে বিশ্বাস করে না, তাদের মনে সবসময় না পাওয়ার হতাশার আগুন জ্বলে। কাঙ্খিত বস্তুটি হাতে আসেনি কেন তা নিয়ে হাহুতাশ করতে থাকে। তার কাছে যেটি আছে তার চেয়ে ভালোটি কেন পেল না, তার জন্য অস্থিরতার শেষ নেই। জীবন নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব মিলাতে পারে না। অনেক সময় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। জাপানের মতো ঈর্ষর্ণীয় শিল্পোন্নত দেশে আত্মহত্যার হার এতবেশি কেন তার জবাব তকদিরে অবিশ্বাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে। অথচ ইসলামী আকিদা বিশ্বাসে লালিত বাংলাদেশের সমাজে দারিদ্র ও অভাবের কষাঘাত সত্ত্বেও মানুষ এক প্রকার মানসিক শান্তির ছায়ায় বাস করে এ কারণেই।

আল্লাহর উপর আল্লাহর নবী রাসূলগণের তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতা ছিল সর্বোচ্চ মাত্রার। এই তাওয়াক্কুল নিয়েই তারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। প্রিয়নবীজিকে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। তার দাঁত মোবারক পর্যন্ত শহীদ হয়েছে। মাহে রমজানেই তিনি বদর যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের অভিযান পরিচালনা করেছেন। কাজেই পরিস্থিতির ভালোমন্দের ভালো মন্দের ভার আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে নির্বিকার তপস্যায় রত থাকার সুযোগ কারো নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত