মানুষ গড়ার সাধনা রমজানের রোজা

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

রোজ থেকে রোজা। ফারসি শব্দ রোজ অর্থ দিন। দিনভর উপবাস ও যৌন সংসর্গ ত্যাগ করার ইবাদত বলে হয়ত রোজা নামকরণ হয়েছে। ইদানীং রোজা না বলে সিয়াম বলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সিয়াম কুরআন ও হাদিসের পরিভাষা সত্য; কিন্তু এই সিয়ামের তরজমা হিসেবে রোজা বলতে এলার্জির কারণ বোধগম্য নয়। সিয়াম বহুবচন। একবচন বোঝাতে বলতে হবে সওম। রোজা বলতে যদি সওম ছাড়া অন্যকিছু বুঝাত তাহলে আপত্তির একটা যুক্তি থাকত।

নামাজ খোদা প্রভৃতি শব্দ নিয়েও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন কিছু লোক। আরবি সালাত ফারসির সূত্রে আমাদের সাহিত্যে ও জনগণের কাছে নামাজ হিসেবে পরিচিত। নামাজ বলতে বিশেষ নিয়মের ইবাদত ছাড়া অন্যকিছু বুঝায় না। অথচ সালাত শব্দটি কুরআনে করিমেই তিনটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি অর্থ নামাজ, দ্বিতীয়টি নবীজির প্রতি দরূদ এবং তৃতীয়টি সাধারণ দোয়া। এখন নামাজ বলতে যদি প্রথম অর্থে সালাত ছাড়া অন্যকিছু না বুঝায় তাহলে বাংলাভাষা থেকে শব্দটি ছাঁটাই করার বাতিক কেন পেল আমার বুঝে আসে না। খোদা শব্দের দ্বারাও মহামহিম আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বুঝায় না। বিষাদ সিন্ধুতে মীর মশররফ হোসেন আল্লাহ অর্থে ইশ্বর ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ইশ্বর শব্দ দেবদেবি অর্থেও ব্যবহৃত হয় বিধায় শিরকের গন্ধ আসে, তাই বৃহত্তর মুসলিম জনতা তা গ্রহণ করেনি। কিন্তু খোদার মধ্যে তো সে ধরনের দুর্গন্ধ নেই। এরপরও একটি শ্রেণি খোদা হাফেজ বলতে নাক ছিঁটকান। অথচ ‘আল্লাহ হাফেজ’ পরিভাষাটি কুরআন বা হাদীসে নাই, আরব বিশ্বেও এর চল নাই। অনিচ্ছায় মন থেকে কথাগুলো বলে ফেললাম।

প্রশ্ন করা হয়, একটানা এক মাসকাল দিনভর উপবাসব্রত পালন করাতে কী লাভ? এই প্রশ্নের জবাব কুরআন মজিদে আছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)

বস্তুত মানুষকে তাকাওয়ার গুণে সজ্জিত করাই রোজার উদ্দেশ্য। তাকওয়া অর্জনের পদ্ধতি হিসেবে আগেকার দিনের উম্মতগুলোর উপরও রোজা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্য থাকে জ্ঞান অর্জন ও ব্যক্তিত্ব গঠন করা। অনুরূপ রমজানের এক মাসের পাঠশালায় যাকিছু অনুশীলন হয় তার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া বলতে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা মিশ্রিত সংযমী জীবন বুঝায়।

দৃশ্যত মানুষ অন্য প্রাণী বা জীব জানোয়ারের মতো। তবে তার মধ্যে কতক মানবিক বৈশিষ্ট্য আছে, যে কারণে অন্যসব প্রাণী থেকে মানুষ আলাদা। এসব মানবিক বৈশিষ্ট্যের নাম এক কথায় সংযমী জীবন, ধর্মীয় পরিভাষায় তাকওয়া।

তাকওয়া বা মানবিক গুণ কেবল মৌখিক উপদেশ দিয়ে অর্জিত হয় না। অনেক শিক্ষিত লোক আছে, যাদের ভেতরগত চরিত্র পশুর চেয়েও আতঙ্কজনক। দুর্বলের উপর অত্যাচার করতে, পরের মাল আত্মসাৎ করতে, খুনখারাবি, সুদ ঘুষে ডুব দিতে এদের বিবেকে বাধে না। কুরআনের ভাষায় এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।

ইসলাম মানুষকে জানোয়ার স্বভাব থেকে উদ্ধার করে মানবীয় গুণে গুণান্বিত ও ফেরেশতাদের সিজদা পাওয়া সেই মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চায়। তার জন্য যেসব পথ নির্দেশ করেছে তার একটি এক মাসের সিয়াম সাধনা।

ভোর রাত থেকে যখন রোজা পালন শুরু করে তখন রোজাদারের চেতনায় বিরাজ করে মহান আল্লাহ তাআলার ভয় ও ভালোবাসা। এ সময় প্রচন্ড ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হলেও রোজাদার লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে পানাহার করে না। তার মনপ্রাণ আপ্লুত থাকে আল্লাহর ভালোবাসায়। হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত ‘প্রত্যেক সৎকর্মের প্রতিদান দশ থেকে সত্তরগুণ দেয়া হয়। এই প্রতিদান বা সওয়াব বণ্টন করেন ফেরেশতারা। কিন্তু আল্লাহ বলেন, রোজার হিসাব আলাদা। রোজা আমার জন্য। আমিই এর প্রতিদান দেব। রোজার সওয়াব সরাসরি আল্লাহ দেবেন, যা মানুষের কল্পনার বাইরে। মূূলত রোজাদার আল্লাহর ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়।

মানুষের জীবনের ভিত্তি হলো, তার ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্বের ভিত্তিমূলে রয়েছে তার ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাশক্তি দিয়েই মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। দুএক দিন নয়, পুরো একমাস সাধনার ফলে ইচ্ছাশক্তি এতই প্রবল ও জোরদার হয় যে, তার সামনে সব ধরনের লোভ, আসক্তি ও নফসের দাবি পরাজিত হয়।

জীবন যুদ্ধে মানুষের পরাজয় বা পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ অলসতা। চিন্তা করলে বুঝা যাবে, মুসলিম সমাজ থেকে অলসতার মহামারি দূর করার জন্য রমজান আসে। রোজাদার ভোর রাতে ঘুম থেকে জাগতে হয়। তাকে দেহ বিছানায় এলিয়ে দেয়ার দাবি উপেক্ষা করে ফজরের নামাজ আদায় করতে হয়। সারাদিন উপবাস শেষে সূর্যাস্তের পর কাঁটায় কাঁটায় হিসেব করে ইফতার করে। তারপর শরীর ধরে রাখা যখন প্রায় অসম্ভব তখনই আত্মার জগতে ডাক আসে, চলো মসজিদে চলো খতম তারাবীহর এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। বয়োবৃদ্ধ লোকেরাও দীর্ঘ দেড় দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজে পবিত্র অবস্থায় হাফেজের পেছনে আল্লাহর কালামের তেলাওয়াত শোনে।

অনেকে নিজে ভালো মানুষ। কিন্তু পুরো সমাজ ভালো না হলে নিজের ভালোত্ব কয়দিন টিকবে। অন্যান্য ধর্মেও কৃচ্ছসাধনার কঠোর কঠিন বিধান আছে। সেই কৃচ্ছতায় এক শ্রেণির সাধু বা পুরোহিত হয়ত সিদ্ধি লাভ করে। তাতে তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিয়ে-শাদীর মতো মানব সভ্যতার সবচে প্রয়োজনীয় দাবিটিও তারা অস্বীকার করে। কিন্তু ইসলামের কৃচ্ছসাধনা দেখুন, সমাজের মাঝে আবার মনের দিক দিয়ে আল্লাহর সাথে। সবাই মিলে পুরো সমাজকে কৃচ্ছতা পবিত্র চেতনা ও সংযম সাধনায় উজ্জীবিত করার অপূর্ব আয়োজন মাহে রমজান।