ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সত্যমিথ্যার চিরন্তন লড়াই বদরযুদ্ধ

সত্যমিথ্যার চিরন্তন লড়াই বদরযুদ্ধ

আজ ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদরযুদ্ধ দিবস। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান, ১৩ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ মদিনার মুসলমান ও মক্কার কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, ইসলামী শক্তি ও কুফরি শক্তির ভাগ্য নির্ধারণী প্রথম লড়াই। এই লড়াইয়ের গুরুত্ব তখনকার আরব সমাজের জন্য নয়, বরং দুনিয়ার অস্তিত্ব যতদিন আছে, বদর যুদ্ধ ততদিন ইসলাম ও কুফর এবং সত্য ও মিথ্যার ভাগ্য নির্ণয় করবে।

বিষয়টি তখনই উপলব্ধি করতে পারব, যখন দেখব যে, আল্লাহর পক্ষ হতে নাজিলকৃত মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিশাল এলাকাজুড়ে বদর যুদ্ধ নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাতে যুদ্ধের খুঁটিনাটি সব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। যেমন কীভাবে যুদ্ধের সূত্রপাত হলো, মুসলমানরা প্রথমে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করতে চেয়েছিল, পরে আল্লাহ মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপান্তর করলেন, মুসলিম ও শত্রুপক্ষ কুরাইশ বাহিনীর পরস্পরের উপর গোয়েন্দা নজরদারি, বৃষ্টির কারণে রণাঙ্গনের মাটি শক্ত বা পিচ্ছিল হওয়া, পানির উৎস বদর কূপের নিয়ন্ত্রণ মুসলামানদের দখলে রাখা, যুদ্ধের ময়দানে ক্লান্ত মুজাহিদদের চোখে ঘুমের চোট আসা, নবীজি যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম যোদ্ধাদের ব্যুহ রচনা ও শত্রু বাহিনীর দিকে ধূলি নিক্ষেপ করা, শত্রু বাহিনীর ওপর আক্রমণের ধরন, আসমান থেকে ফেরেশতা নাজিলের প্রস্তাবনা, সম্মুখ লড়াইয়ে ফেরেশতাদের অংশগ্রহণ, যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মালের ভাগ-বাটোয়ারা, যুদ্ধবন্দিদের হত্যা না করে মুক্তিপণ আদায়ের সমালোচনা প্রভৃতি ছোটোখাটো সব বিষয়। এর সাথে হাদিস শরিফের বর্ণনাগুলো সমানে আনলে মনে হবে বদরের রণাঙ্গন আমাদের সামনেই উপস্থিত। একটি যুদ্ধ নিয়ে কুরআন ও হাদিসে এভাবে পর্যালোচনার পেছনে নিশ্চয়ই তাৎপর্য আছে, ভবিষ্যতের জন্য পথের দিশা আছে।

আমরা কুরআন তেলাওয়াত করি, রমজানে তারাবি নামাজে কুরআন খতম করি, অথচ ৩০ পারা কালামুল্লাহ শরিফের প্রায় আধা পারাজুড়ে যে যুদ্ধ নিয়ে পর্যালোচনা রয়েছে তার খবর খুব কম লোকই রাখি। এর পরিণতি দাঁড়িয়েছে আজকের ফিলিস্তিন ও গাজায় মুসলমানদের ওপর আল্লাহর পক্ষ হতে অভিশপ্ত জাতি জায়নবাদী ইহুদীদের নিধনযজ্ঞ।

কুরআন মজিদে ইহুদীদের অভিশপ্ত ও সূরা ফাতেহায় আল্লাহর ক্রোধের শিকার জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষ আজ ইসরাঈলের প্রতি ক্ষুব্ধ, তাদের নিন্দায় সোচ্চার। যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে লাগাতার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে নির্লজ্জভাবে ইসরাঈলের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও আমেরিকা বাধ্য হয়েছে, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে। ইসরাঈলের মনুষ্যত্ববর্জিত এই যে আচরণ এবং তার প্রতি বিশ্ব জনমতের নিন্দা ও ক্ষোভ তা প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধের প্রতিফলন।

দেড় হাজার বছর আগের আকাশ ও চাঁদ সূর্য অবিকল আছে। বদর উহুদ, খন্দক ও অন্যান্য যুদ্ধে সাহায্যকারী আল্লাহও আছেন। এরপরও ইসরাঈলী হায়েনাদের মোকাবিলায় ফিলিস্তিনিদের জন্য আসমানি সাহায্য আসতে আমরা দেখছি না কেন- এমন প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বদর যুদ্ধসহ ইসলামের প্রথম যুগের যুদ্ধগুলোর প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা সামনে রাখতে হবে। তার সাথে আমাদের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

ফিলিস্তিনের আরবরা স্বজাতি বলে দাবিদার আরব শেখরা যখন ইহুদিদের বন্ধু ভেবে তাদের জন্য অন্দর মহলের দরজা খুলে রাখেন, আল্লাহর দেয়া অর্থবিত্ত জায়নবাদীদের ব্যাংকে জমা রেখে হাত গুটিয়ে সুখের দিবাস্বপ্ন দেখেন, ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের রক্ত নিয়ে যখন ইসরাঈলী বাহিনী হলি খেলছে, তখন পাশের দেশে রুমালধারী শেখগণ বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- আল্লাহ কাদেরকে সাহায্য করবেন। হ্যাঁ, মজলুম ফিলিস্তিনিরা আল্লাহর সাহায্য পাচ্ছেন, যে কারণে বিশ্বে নামধারী মুসলমানদের চেয়ে অমুসলিম দেশগুলো গাজাবাসীর জন্য অধিকতর বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছেন।

দুনিয়ার সকল মানুষ বিশ্বাস করে, মিথ্যার উপর সত্যের জয় হবেই নিশ্চয়। সে হিসেবে সত্যের উপর অবিচল থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হামাসের বিজয় অবশ্যম্ভাবী, তবে যে কোনো স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য রক্তের নজরানা পেশ করতে হয়। গাজায়ও এই সত্যটির মঞ্চায়ন হচ্ছে।

আমরা বদরযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে চাই এই রমজানে। কেন না, নবীজি রমজান মাসেই এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমরা রমজানে সাধারণত অভ্যন্তরীণ শত্রু শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলি; কিন্তু রমজান তো অভ্যন্তরীণ শত্রুকে পরাস্ত করার সাধনার মতো বাইরের শত্রুকে পরাভুত করারও সংগ্রাম। যার আরেক প্রমাণ অষ্টম হিজরির ২০ রমজান পরিচালিত মক্কা বিজয়ের অভিযান।

বদর যুদ্ধের একপক্ষে ছিল মক্কা থেকে দেশত্যাগ করে আসা মোহাজির ও মদিনার আনসার। রণাঙ্গনে তাদের সর্বাধিনায়ক আল্লাহর নবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। শত্রুপক্ষে মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্র অন্যান্য আরব গোত্র। তাদের অধিনায়ক আবু জেহেল। শত্রুপক্ষ কুরাইশ বাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী ছিল ৯৫০ জন এবং ঘোড়া ছিল ১০০ ও উট ১৭০টি। আর মুসলিম বাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহী ছিল ৩১৩ জন, দুটি ঘোড়া ও ৭০টি উট। এই অসম যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয়। তাদের পক্ষে শাহাদত বরণ করেন মাত্র ১৪ জন; ছয়জন মুহাজির ও আটজন আনসার। কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দি হয়। রণাঙ্গনের অবস্থান ছিল মক্কা ও মদিনার মাঝখানে মদিনা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে। যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ইনশাআল্লাহ আগামীকালের সংখ্যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত