ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কমছে না পরিবারের উৎকণ্ঠা

এমভি আব্দুল্লাহ’র নাবিকদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাড়ছে বিতর্ক

এমভি আব্দুল্লাহ’র নাবিকদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাড়ছে বিতর্ক

ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’কে উদ্ধারে আপ্রাণ চেষ্টা করছে মালিকপক্ষ। দস্যুদের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে কিছু দিন পরপর। এ নিয়ে উৎকণ্ঠা কমছে না ভুক্তভোগী পরিবারে। এর মধ্যেই নাবিকদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজটি উদ্ধারে সময় ক্ষেপণের সঙ্গে নাবিক-ক্রুদের ব্যর্থতার বিভিন্ন দিক নিয়েও বিস্তর আলোচনা হচ্ছে শিপিং সেক্টরে। প্রশ্ন উঠেছে, জলদস্যুদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ থাকলেও কেন নাবিকরা তা কাজে লাগায়নি। অভিযোগ উঠেছে, তিন নাবিকের ভুলে জলদস্যুদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে যায় এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুদের তৎপরতা আঁচ করতে পেরে ২০ জন নাবিক জাহাজটির গোপন কক্ষে চলে যান। ব্রিজ এবং ব্রিজের নিচে থেকে যান শুধু তিন নাবিক। তাদের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গোপন কক্ষে যাওয়া ২০ নাবিককে একে একে ব্রিজে নিয়ে আসা হয়। এরপর পুরো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জলদস্যুদের হাতে। তবে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকরা অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা বলেছেন, সিটাডেল বা গোপন কক্ষে তখনই নাবিকরা যান, যখন কারো সহায়তার ব্যাপারে আশ্বাস পান। এর আগে গোপন কক্ষে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা সাহায্যের কোনো আশ্বাস পাননি। নাবিকদের এ ব্যাপারে দোষারোপ করা যাবে না।

শিপিং সেক্টরের সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি বাণিজ্যিক জাহাজসহ বড় জাহাজে একটি গোপন কক্ষ থাকে। জলদস্যুরা জাহাজে উঠে গেলে নিয়ম অনুযায়ী নাবিকরা ওই কক্ষে আশ্রয় নেন। ওই কক্ষ সিটাডেল নামে পরিচিত। সিটাডেল অনেকটা দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো। জাহাজ নির্মাণের সময়ই এ কক্ষ নির্মাণ করা হয়।

এ কক্ষে বিপদের সময় আশ্রয় নেন নাবিক ও ক্রুরা। জলদস্যুরা ছাড়াও যেকোনো ধরনের সামরিক আক্রমণের সময় সিটাডেলে আশ্রয় নেন। ওই কক্ষে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলে সেখানে কোনোভাবে প্রবেশের সুযোগ নেই কারো। কক্ষটি বুলেট প্রুফ। সেখানে জরুরি প্রয়োজন মেটানোর মতো খাবার মজুত থাকে। সুরক্ষিত সিটাডেল মর্টারশেলের আঘাতেও ভাঙা যায় না। গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জলদস্যুরা এমভি আবদুল্লায় উঠে পড়ার সময় নিয়ম মেনে ২০ জন নাবিক-ক্রু সিটাডেলে আশ্রয় নেন। কিন্তু জাহাজের ব্রিজে থেকে যান মাস্টার এবং সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। ব্রিজের নিচেও ছিলেন একজন সেকেন্ড অফিসার। ব্রিজে নাবিকদের জিম্মি করে জলদস্যুরা সিটাডেলে আশ্রয় নেওয়া নাবিকদের বের করে আনেন। এরপর সবাইকে ব্রিজে আটকে রেখে জাহাজের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয় জলদস্যুরা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানান, জলদস্যুরা জাহাজে উঠে যাওয়া কিংবা আক্রান্ত হওয়ার সময় নাবিকদের বেশির ভাগই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অর্থাৎ সিটাডেল নামে জাহাজের দুর্ভেদ্য গোপন কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েকজন বাইরে থাকায় এবং গোপন কক্ষে অন্যদের মতো আশ্রয় না নেওয়ায় জলদস্যুরা মূলত নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার সুযোগ পায়। সবাই যদি সিটাডেলে আশ্রয় নিত তবে জলদস্যুরা সহজে নিয়ন্ত্রণ নিতে পারত না।

তবে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেছেন সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান। তার মতে, সিটাডেলে নাবিকরা তখনই আশ্রয় নেন, যখন তাদের উদ্ধারের জন্য কারো আশ্বাস মেলে। এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা জলদস্যুদের কবলে পড়ার সময়ে ক্যাপ্টেন আশপাশের জাহাজগুলোর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এসওএস বার্তা নামে পরিচিত ওই বার্তা পাওয়ার পর কারো কোনো সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় সিটাডেলে যাওয়াই বিপজ্জনক। সেখানে স্যাটেলাইট ফোন ছাড়া আবদ্ধ থাকা কঠিন। কেউ কমান্ডো অভিযান চালাবে এ রকম আশ্বাস পেলে কয়েক ঘণ্টার জন্য কেবল নাবিকরা সিটাডেলে যেতে পারত। এ ক্ষেত্রে নাবিকদের কোনো দোষ নেই। তারা কারো আশ্বাস না পেয়ে সিটাডেলে না গিয়ে ভালোই করেছে।

এদিকে, জিম্মি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিককে উদ্ধার করতে কোনো ধরনের সামরিক অভিযানের পক্ষে নয় মালিকপক্ষ। এ বিষয়ে জাহাজের মালিকপক্ষ এবং সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্ট মহলে বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে নাবিকদের উদ্ধারে জলদস্যুদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে মালিকপক্ষ।

এ বিষয়ে জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম জানান, নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় মুক্ত করে আনা আমাদের লক্ষ্য। এজন্য আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। তবে জিম্মি জাহাজে সোমালি পুলিশ কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সসহ যেসব সামরিক অভিযানের কথা আসছে, এগুলো আমরা জানি না। আমাদের বার্তা স্পষ্ট। আমরা কোনো ধরনের সামরিক অভিযানের পক্ষে নই। কারণ আমরা নাবিকদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক মাধ্যমে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, নাবিকদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছে। তারা ভালো আছেন। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি। সবমিলিয়ে আমরা নাবিকদের সুস্থভাবে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর। প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ দুপুরে কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জিম্মি করে সোমালি জলদস্যুরা। সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। আটকের পর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দফা স্থান পরিবর্তন করে জাহাজটিকে সবশেষ সোমালিয়ার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙর করে রাখা আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত