ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বড় হচ্ছে ঈদ অর্থনীতি

ছাড়িয়ে যেতে পারে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা

ছাড়িয়ে যেতে পারে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা

বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়ায় ঈদুল ফিতর ঘিরে ব্যাপক কেনাকাটা শুরু হয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন মার্কেটে বাড়তে শুরু করেছে ক্রেতাদের ভিড়। ঈদের প্রায় ১৫ দিন বাকি থাকলেও পাইকারি বাজারের বিক্রি প্রায় শেষের দিকে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি দেশে অর্থনৈতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও এবারের ঈদে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যবসা-বাণিজ্য হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, ঈদের আগেই সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা একসঙ্গে বেতন ও বোনাস পাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে মানুষের হাতে টাকা থাকবে যা ঈদের কেনাকাটায় ব্যয় করবেন। উৎসবের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। এরপরও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হিসাব বলছে, ঈদে অর্থনীতিতে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা লেনদেন হবে। খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে এই বাড়তি অর্থ যোগ হয়।

ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষ কেনাকাটা শুরু করেছেন। নগরীর ফুটপাত থেকে শুরু করে মার্কেট, বিপণিবিতান, শপিংমলে ক্রেতার উপচেপড়া ভিড়। চাঙা হয়েছে দেশের অর্থনীতি। বেড়েছে ঈদ-অর্থনীতির আকার ও অঙ্ক; যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে। ঈদ উপলক্ষ্যে অর্থের বড় একটা জোগান আসছে প্রবাসী রেমিট্যান্স, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-বোনাসে অভ্যন্তরীণ বাজার গতিশীল হচ্ছে।

ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। ঈদের দুই সপ্তাহ বাকি থাকায় এখনো অনেক ক্রেতা কেনাকাটা শুরু করেননি বলেও মনে করছেন তারা। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের কয়েকজন বিক্রেতা বলেন, এবারের ঈদে ব্যাপক কেনাকাটা হবে। কারণ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা ঈদের আগে বেতন ও বেনাস দুটোই একসঙ্গে পাবেন। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকের হাতে টাকা থাকায় গত ঈদের চেয়ে এবার কেনাকাটা বাড়বে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শফিউল বারী বলেন, কিছুদিনের মধ্যেই ঈদ সেজন্য আগেভাগে পোশাক কিনতে বের হয়েছি। কারণ ঈদের আগমুহূর্তে মার্কেটে ক্রেতাদের ব্যাপক ভিড় থাকে, তখন পছন্দের কাপড় কেনা কষ্টকর হয়ে পড়ে।

গতকাল বৃহস্পতিবার জিহাদুল স্বপন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, পছন্দের জুতা কিনতে কয়েকটি ব্র্যান্ডের দোকান ঘুরেছি। মনের মতো জুতা মেলানো সম্ভব হয়নি। পছন্দের জুতা পেলে কিনব। শুধু জুতা নয়, পরিবারের সদস্যদের জন্য পোশাক কেনার পরিকল্পনা করছেন তিনি। বেসরকারি চাকরিজীবী ফরিদুল ইসলাম বলেন, মায়ের জন্য শাড়ি ও আমার জন্য প্যান্ট কিনেছি। এখন বাবার জন্য পাঞ্জাবি কেনার কথা ভাবছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রেতাদের সরাসরি মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটার পাশাপাশি অনলাইনেও কেনাকাটা বেড়েছে। ঈদের অর্থনীতিতে পোশাক, জুতা, ভোগ্যপণ্য ও ইলেক্ট্রনিক্সের মতো শীর্ষ ১০ পণ্যের কেনাকাটায় বাণিজ্য হয় দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে। এর বাইরে আরো অনেক রকম পণ্যের কেনাকাটা ও লেনদেন হয় প্রায় আরো ৫০ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, প্রতি বছর নতুন নতুন চাহিদা বাড়ায় বড় হচ্ছে ঈদের অর্থনীতি। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের কেনাকাটা করছেন। ফলে বাড়ছে ঈদের অর্থনীতির আকার। এক কোটি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরো প্রায় দেড় কোটি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বোনাস ঈদ মার্কেটে যোগ হবে। এ পরিমাণ টাকার সবই ঈদ অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য মতে, ঈদে দেশে প্রায় ২৫ লাখ দোকানে কেনাকাটা হয়। মুদি থেকে শুরু করে এসব দোকানের মধ্যে কাপড়ের দোকান, শোরুম ও ফ্যাশন হাউজগুলোও রয়েছে। এসব দোকানে বছরের অন্য সময় প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজার মাসে সেটি তিনগুণ বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। ওই হিসাবে রোজার এক মাসে এই ২৫ লাখ দোকানে ঈদ পোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হয় প্রায় ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি।

রাজধানীর নিউমার্কেট, গুলিস্তান, উত্তরা ও ফার্মগেটসহ বিভিন্ন ঘুরে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষ্যে জমে উঠে মার্কেট। রাজধানীজুড়ে প্রায় অর্ধশত রাস্তার ফুটপাতে চলছে ঈদের কেনাবেচা। এর মধ্যে দৈনিক বাংলা মোড়, মতিঝিল জনতা ব্যাংকের সামনে, মতিঝিল শাপলা চত্বরের চারদিকের ফুটপাত, বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর-পশ্চিম গেটের সামনে, ফকিরাপুল এলাকা, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হকার্স সমিতি মার্কেট, গুলিস্তান মোড়ের চারপাশের ফুটপাত, নয়াপল্টনের ভিআইপি সড়কের ফুটপাত, গোলাপশাহ মাজার সংলগ্ন ফুটপাত, বঙ্গবাজার, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনি চকের ফুটপাতেও জমে উঠেছে ঈদের বেচাকেনা। রাজধানীর উত্তরায় অভিজাত মার্কেটের সামনে ফুটপাতে শার্ট-প্যান্ট ও বাচ্চাদের পোশাক কিনতে দেখা গেছে অনেককেই।

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবারের মতো এবারের ঈদ কেনাকাটার সবার শীর্ষে থাকবে পোশাক। এর পরই জুতাণ্ডস্যান্ডেল, লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছা। খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই-চিনি, মাংস, মিষ্টি, গ্রোসারি পণ্য রয়েছে। প্রসাধনী, ইলেক্ট্রনিক্স টিভি, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যও কেনা হয় ঈদ উপলক্ষ্যে। অনেকে আবার সোনার গয়না, ঘরের আসবাবপত্র কেনেন।

এফবিসিসিআইয়ের এক গবেষণায় বলা হয়, ঈদে পোশাকসহ পরিধেয় খাত থেকে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ কোটি, জুতাণ্ডকসমেটিকস ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্য ৭ হাজার কোটি, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, সোনা-ডায়মন্ড ৫ হাজার কোটি, ভ্রমণ খাতে সাড়ে ৫ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিক্স ৪ হাজার কোটি, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় এক হাজার কোটি, পবিত্র ওমরাহ পালন ৩ হাজার কোটি, আইনশৃঙ্খলাসহ অন্য খাতে লেনদেন হয় আরো ১ হাজার কোটি টাকা। তবে এফবিসিসিআইয়ের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংগঠনের তথ্যে দেখা গেছে, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ঈদুল ফিতর ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন বাড়বে তেমনি চাঙ্গা হয়ে উঠবে গোটা অর্থনীতি। ভোগ-বিলাস খাতেই বেশির ভাগ টাকা যাচ্ছে। তবে কিছু অংশ যাচ্ছে গ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্পভিত্তিক উৎপাদন খাতে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, ঈদ উৎসব ঘিরে বাড়তি টাকার প্রবাহে সচল হয়ে ওঠে গ্রামের অর্থনীতি। এ সময় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও টাকা যায়। এতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। তবে বাড়তি টাকার প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদ উৎসবের কেনাকাটায় শুধু বস্ত্র কিংবা জুতা নয়, ভোগ্যপণ্য, ইলেক্ট্রনিক পণ্য, ভ্রমণ, পবিত্র ওমরা পালন, ফার্নিচার, গাড়ি ও আবাসন খাতসহ প্রতিটি সেক্টরে নগদ টাকার লেনদেন হচ্ছে। উৎসব ঘিরে যেমন ব্যয় হচ্ছে, তেমন জোগানও এসেছে। এরই মধ্যে ব্যাংকিং খাতে লেনদেনও বেড়েছে ব্যাপক হারে। রেকর্ড গতিতে দেশের অর্থনীতিতে জমা হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেব্রুয়ারি শেষে রেমিটেন্স এসেছে ২১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, আগের বছরের একই মাসের চেয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৮ শতাংশ। প্রবাসী আয়ের নাজুক অবস্থা গত কয়েক মাসে কিছুটা কাটিয়ে ওঠার মধ্যে এ পরিমাণ রেমিট্যান্স চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একক মাসে সর্বোচ্চ। এর আগের মাস জানুয়ারিতে চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়, প্রবাসীদের ও তাদের সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে জমা হয় ২১১ কোটি ৩১ লাখ ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনের পর সদ্য সমাপ্ত ফেব্রুয়ারিতে এতটা বেশি রেমিট্যান্স এলো। গত জুনে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসা রেমিটেন্স ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে ৬০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার বা ২৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। গত ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫৬ কোটি ডলার এসেছিল দেশে। ওই সময় দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৫ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফনের পর রিজার্ভ বেড়ে গ্রস হিসাবে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল ২৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। বিপিএম৬ পদ্ধতির গ্রস হিসাবে তা ২১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। সাধারণত রোজা, ঈদ, বাংলা নববর্ষকে ঘিরে প্রবাসীরা অন্য সময়ের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠিয়ে থাকেন। এবার মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে রোজা শুরু হয়েছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হবে ঈদ। এতে চলতি মাসের পাশাপাশি আগামী মাসেও রেমিটেন্স প্রবাহ আরো বাড়তে পারে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত পাঁচ মাস ধরেই ইতিবাচক ধারায় থাকা রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি একটু একটু করে বাড়ছে। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে নেতিবাচক ধারায় ছিল। ফেব্রুয়ারির রেমিটেন্স নিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি আট মাসে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট আয় দেশে পাঠিয়েছেন ১৫ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ১৫ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। ওই অর্থবছরে মোট ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল, প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ঈদ উপলক্ষ্যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ মোবাইলে দৈনিক লেনদেনের মাত্রা বেড়েছে। ঈদকেন্দ্রিক ই-কমার্স রাজধানী ছাড়িয়ে জেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ই-কমার্সে বার্ষিক লেনদেনের আর্থিক আকার শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে হাজার কোটি টাকায় রূপ নিয়েছে। আগামী এ আকার ব্যাপক হারে বাড়বে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত