বদর রণাঙ্গনে মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী

প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

মক্কার কুরাইশদের নির্মম নির্যাতনের মুখে দেশত্যাগ করে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছেন মহানবী (সা.) ও মুহাজির মুসলমানরা। তাদের সহায় সম্পদ জব্দ করে নিয়েছে মক্কার কুরাইশরা। দেশত্যাগ বা হিজরতের দ্বিতীয় বছর নবীজি খবর পেলেন একটি কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া যাচ্ছে এবং তাতে কুরাইশ ও তাদের মিত্র সব গোত্রের পুঁজিপাট্টা আছে। তাদের যাওয়ার পথ মদিনার পাশ দিয়ে। যারা মুসলমানদের সহায় সম্পদ জব্দ করে জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে তারা মদিনার পাশ দিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করবে তা হতে পারে না। শত্রু অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলে ভবিষ্যতে আরো বিপদ আছে।

নবীজি ১৫০ জন, মতান্তরে ২০০ জনের একটি দল নিয়ে সিরিয়াগামী কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলাকে বাধা দিতে অগ্রসর হলেন। কিন্তু যুল-উশাইরা নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারলেন কয়দিন আগেই কুরাইশ কাফেলা, সে স্থান অতিক্রম করে সিরিয়া রওনা হয়েছে।

নবীজি (সা,) সেখান থেকে ফিরে এলেন। তবে গোয়েন্দা নজরদারি আরো বিস্তৃত করলেন। রমজান মাসের শুরুর দিকে সংবাদ পেলেন কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। প্রচুর বাণিজ্যিক মালামাল নিয়ে ৪০ জনের এই কাফেলা মদিনার উপকণ্ঠ হয়ে মক্কায় ফিরে যাবে। কাফেলার নেতৃত্বে আছে আবু সুফিয়ান।

নবীজি আনসার ও মুহাজিরদের সমবেত করে কুরাইশ কাফেলাকে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার হুকুম দেন। ৪০ জনের কুরাইশ কাফেলার সঙ্গে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না বিধায় তেমন যুদ্ধ প্রস্তুতিও নিল না মুসলমানরা। কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ানের মনেও শঙ্কা ছিল মুসলমানরা আক্রমণ করতে পারে। এই আশঙ্কা আঁচ করতে পেরে জামজাম নামক এক লোককে ভাড়ায় এই বলে মক্কায় পাঠাল যে, আমাদের বাণিজ্য কাফেলা মুহাম্মদের আক্রমণের মুখে। কাফেলাকে আসন্ন আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাও।

সংবাদ পৌঁছামাত্র পুুরো মক্কা গর্জে উঠল। বাণিজ্য কাফেলায় সবার পুঁজি ও অংশীদারিত্ব ছিল বিধায় সবাই সাজসাজ রবে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হলো।

ওদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমর ইবনে মাকতুমকে মদিনায় নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে ৮ রমজান রওনা হলেন যুল-হুলায়ফার উদ্দেশ্যে। ‘সুখাইরাত ইয়ামাম’ পর্যন্ত পৌঁছার পর তিনি বী’রে রওয়াহার দিকে বেঁকে যান এবং প্রসিদ্ধ সড়কপথ ছেড়ে ডান দিকে ‘সাফরা’য় উপনীত হন। এখানে পৌঁছার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা) বাসবাস ইবনে আমরকে আবু সুফিয়ানের অবস্থা তল্লাশির জন্য বদর প্রান্তরের দিকে পাঠালেন আর নিজে সাহাবায়ে কেরামসহ সাফরার ডান দিক হয়ে ‘যাকরান’ প্রান্তরে উপনীত হন। সেখানে পৌঁছার পর তার কাছে খবর আসে যে, মক্কা থেকে বিশাল কুরাইশ বাহিনী আসছে। তিনি মুহাজির ও আনসারদের সমবেত করে তাদের পরামর্শ নিলেন। মুহাজিরদের পক্ষ হতে যে কোনো পরিস্থিতিতে নবীজির যে কোনো আদেশ শিরোধার্য করার কথা জানানো হল। নবীজি আনসারদের মনোযোগ আকর্ষণ করলেন। আনসারদের মাঝ থেকে সাআদ ইবনে মুয়াজ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার পবিত্র হাতে বাইয়াত করেছি। আপনি যদি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশও দেন, তাহলে আমরা সে আদেশ অমান্য করব না। আমরা বনি ইসরাঈলের মতো হব না, যারা শত্রুর মুখোমুখি হলে আল্লাহর নবী মূসাকে ত্যাগ করেছিল। আনসারদের অভিমত শোনে নবীজি খুশি হলেন। পরক্ষণে তিনি ঘোষণা করলেন, তোমাদের জন্য সুসংবাদ হল, আল্লাহ আমাকে এ যুদ্ধে বিজয় লাভের সুসংবাদ দিয়েছেন। এরপর সে স্থান ছেড়ে তিনি বদর প্রান্তরে পৌঁছেন। তারপর আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) যুবাইর (রা.) ও সাদ (রা.)-কে শত্রুবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠালেন। ঘটনাক্রমে তারা দু’জন বালকের দেখা পেয়ে তাদের পাকড়াও করে আনলেন।

তখন নবী করিম (সা.) নামাজরত অবস্থায় ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে বালকরা বলল, আমরা কুরাইশদের জন্য পানি সংগ্রহ করি। বালকরা সঠিক কথা বলছে না মনে করে তাদের চড়-তাপ্পড় মারতে লাগলেন। তাদের কাছ থেকে আবু সুফিয়ান সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার করাই উদ্দেশ্য। দু’চার তাপ্পড় খেয়ে বালকরা বলা শুরু করল, আমরা কুরাইশ কাফেলার লোক। এরিমধ্যে নবী করিম (সা.) সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করেন এবং ওদের মারতে নিষেধ করেন। নবীজি বালকদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা আমাকে বল, কুরাইশ বাহিনী কোথায় আছে। বালকরা বলল, এই টিলার ওপারে আছে। একদিন ১০টি উট আর পরের দিন ৯টি উট জবাই করে। নবীজি বললেন, মুশরিকদের সংখ্যা ১ হাজার ৯০০-এর মাঝামাঝি। আবু সুফিয়ানও নবী করিম (সা.)-এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য বের হয়। মাজদি নামক এক লোককে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, হাল আহাসতা আহাদান’ তুমি কি কোনো লোকের আসা যাওয়া লক্ষ্য করেছ। মজদি বলল, ঐ টিলার দিক থেকে দু’জন আরোহী এসেছিল এবং উটগুলো বসিয়ে পানি পান করিয়ে চলে গেছে। আবু সুফিয়ান কথাটি শোনার পরপর সে জায়গায় এসে উটের গোবর হাতে নিয়ে ভাঙল। (গোবরের ভেতরের খেজুরের দানা পরীক্ষা করল) তারপর বলতে লাগল, আল্লাহর কসম এরা ইয়াসরাবের লোক। ইয়াসরাব মদিনার পুরনো নাম। তারপর ওই দু’জন বালকের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে তারা কোনোদিকে গেছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। আবু সুফিয়ান তৎক্ষণাত কাফেলায় ফিরে গিয়ে সমুদ্র উপকূল দিয়ে কেটে পড়ল। এরইমধ্যে মক্কার লোকেরাও এসে পৌঁছল। আবু সুফিয়ান তাদের দেখে খুব খুশি হল এবং বলল, চলো এবার ফিরে যাই। আমাদের কাফেলা তো বিপদমুক্ত। কিন্তু কুরাইশ বাহিনীর প্রধান আবু জেহেল বলল, খোদার কসম ‘যতক্ষণ বদর প্রান্তরে না পৌঁছব এবং সেখানে তিন দিন পর্যন্ত আনন্দ ফূর্তি না করব, ততক্ষণ কোনো অবস্থাতেই ফিরব না।

কুরাইশ বাহিনী পৌঁছার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর প্রান্তরে একটি ছোট্ট কূপের ধারে অবস্থান নিলেন।