ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকেও ব্যর্থ বিএনপি

গণমধ্যমেই সীমাবদ্ধ আন্দোলন

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

দিন দিন ব্যর্থতার পাল্লাভারী হচ্ছে বিএনপির। সরকারবিরোধী আন্দোলন, ভোট বর্জন করেও হালে পানি পাচ্ছে না দলটি। আন্তর্জাতিক মহলেও হারাচ্ছে গ্রহণযোগ্যতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে জনমত গঠন করতে পারছে না দলটির বর্তমান নেতৃত্ব।

সরকারপতন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর অনেক দিন কেটে গেছে বিএনপির। রাজপথের এই বিরোধী দলটি সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো ইস্যু না পেয়ে সম্প্রতি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। তবে সেই ডাকেও জনগণের তেমন সাড়া পাচ্ছে না বিএনপি। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা নিয়ে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। সমালোচনা ও বিভ্রান্তির মধ্যে বিএনপির কোনো কোনো নেতা এই ধরনের আন্দোলনের ডাক দেয়ায় বিব্রত বোধ করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত আমাদের কাছে প্রতিবেশী দেশ এবং আমাদের প্রতিদিনের পণ্যের চাহিদার একটা অংশ ভারতীয় পণ্য দিয়ে পূরণ করা হয়।

এছাড়া আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামালের জন্য ভারতের ওপর অনেকখানিনির্ভর করতে হয়। ভারতীয় শাড়ির কদর বিএনপির নেতাদের স্ত্রীরাও পর্যন্ত অস্বীকার করতে পারবেন না। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলনে হঠাৎ করে গায়ের চাদর ছুড়ে মারার মধ্যদিয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ডাক দেন, সেটা নাকি রিজভীর একান্তবিষয়। বিএনপি দলীয়ভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়নি। তবে বিএনপির কোনো কোনো নেতা জানিয়েছেন, রুহুল কবির রিজভী নাকি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকে শুধু সংহতি জানিয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক কে দিল। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে এবং সে কারণে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়ার পর তা শুধু গণমধ্যম এবং সামাজিকমাধ্যমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো প্রকার প্রচার কার্যক্রম চালান হয়নি। শপিংমলে গিয়ে ভারতীয় পণ্যের কেনা-বেচা বন্ধে দেশের মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করেনি। ভারতীয় পণ্য গ্রহণ কিংবা বর্জন করার এখতিয়ার শুধু জনগণের। জনগণ ইচ্ছা করলে ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে পারে। আবার স্বেচ্ছায় ভাতীয় পণ্য কিনতেও পারেন। বিএনপির এই কমসূচিটি বাস্তবায়ন করার জন্য দলটিকে জনগণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। কেন না, দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কয়জন জানেন বাজারে কোন পণ্যটি ভারতীয়? ভারতীয় পণ্য বর্জন করলে ভারত অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে যাবে, এমনটি ভাবারও কোনো যুক্তি নেই। তবে ভারতীয় পণ্য ছাড়া বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা যে অচল, সেটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে।

সংকটকালে নিত্য পণ্য পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ ভারত থেকে না আসলে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে নামত তা হয়তো বিএনপির নেতারা বুঝে উঠতে পারেননি। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বাংলাদেশের পেঁয়াজের দাম কোথায় গিয়ে উঠেছিল, সেটি অবশ্যই বিএনপির নেতাদের স্মরণে থাকার কথা।

রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির নেতাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- তারা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা করেন না। অনেকটা তাত্ত্বিকতায় বিশ্বাসী হয়ে বিএনপির নেতারা যে কর্মসূচি দেন তা বিগত ১৫ বছরে হালে পানি পায়নি। বিগত দিনে বিএনপির কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততা ছিল না বলে তারা জনগণকে তাদের আন্দোলনে পাশে পায়নি। বিএনপি সহিংস ও অহিংস দুই প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে কোনোটাতেই সফল হতে পারেনি। জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেনি। তেমনি পদযাত্রার মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠবে, সেটা বাস্তবিক অর্থে সম্ভব নয়। আর সে কারণে নির্বাচন বর্জনের মতো কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়ার পরিচয় দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আগামী দিনেও বিএনপি আওয়ামী বিরোধী কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার মতো রাজনৈতিক অবস্থানে নেই। সে কারণে ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচি জমানোর ক্ষেত্রেও বিএনপি কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপি রাজনৈতিক মাঠ এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে অনেকটায় কোণঠাসা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পর পর বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। আওয়ামী লীগ অনেকটা স্থিতিশীলতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে। ফলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে কার্যত হেরে গেছে।

সূত্র জানায়, বিএনপি নেতাকর্মীদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণার পরও দলীয়ভাবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করছে না। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, বিএনপি এখনও দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়নি। পরে যথাসময়ে এ বিষয়ে দলের অবস্থান বা প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির মধ্যে নেতৃত্বের যে সংকট চলছে ভারতবিরোধী ইস্যুতে তা প্রকট হয়েছে। একইসঙ্গে দলটিতে যে মতের পার্থক্য রয়েছে তা-ও স্পষ্ট হয়েছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক বাস্তবে তেমন কোনো প্রভাব পরছে না দেশের রাজনীতিতে।

জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগবিরোধী কয়েকটি দলের তৎপরতায় শুরু হয় ‘ইন্ডিয়া আউট’ বা ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ও সামাজিকমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। গত ২০ মার্চ বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিজের ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে এই আন্দোলনে সংহতি জানান।

গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এই ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ বিষয়টি নিয়ে ও আলোচনা হয়। এতে রুহুল কবির রিজভীর ওই কর্মকাণ্ড তুলে ধরে আলোচনা করা হয়। ভারতীয় পণ্য বর্জনে রিজভীর সংহতি জানিয়ে দেওয়া বক্তব্য ব্যক্তিগত বলে স্থায়ী কমিটিতে জানানো হয়েছে। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন, এই আন্দোলন বা কর্মসূচি বিএনপি আহ্বান করেনি। অন্যান্য বিভিন্ন জায়গা থেকে এই আহ্বান করা হয়েছে।

বৈঠক থাকা দুজন সদস্য বলেছেন, আমরা ভারতের বিরোধিতা করব, কিন্তু কৌশল ঠিক করতে হবে। সেটা না করে, যে যার মতো বক্তব্য দেওয়া উচিত হবে না। দায়িত্বশীল পদে থেকে রিজভীর এ ধরনের কর্মকাণ্ড শোভনীয় হয়নি বলে মনে করে স্থায়ী কমিটি।

এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, মানুষ যখন মার্কেটে যায়, তারা একটা কোয়ালিটি কাপড় দেখে। সেটা মেইড ইন বাংলাদেশ, মেইড ইন ইন্ডিয়া নাকি চায়না এটা দেখে না। ইন্ডিয়ান কাপড় কেনে এমনও না। এটা একটা রাজনৈতিক আবেগ। তবে দলীয়ভাবে এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক দিলারা চৌধুরী বলেন, এই কর্মসূচি নিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির দলের মধ্যেই দ্বন্দ্ব আছে। রিজভীর চাদর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। আরেক দল বলছে ভারতকে আমরা অসন্তুষ্ট করব না। কারণ, তাহলে ক্ষমতায় আসা যাবে না। আবার আরেকদল ভাবছে তাদের অফিসিয়াল স্ট্যান্ড গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্বের জন্য ফাইট করব। সুতরাং দলের মধ্যেই এরকম একটা দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বিএনপির মধ্যে লিডারশিপের ক্রাইসিস চলছে। কে মহাসচিব হবে, সেটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় নির্বাচনে যেহেতু পশ্চিমা দেশের যে সাপোর্ট তা সেভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। তাই এন্টি ভারত সেন্টিমেন্ট সামনে নিয়ে এসে সেটাকে কাজে লাগিয়ে তারা সাফল্য পেতে চায়।

ভারতবিরোধী এই কর্মসূচির কোনো প্রভাব নেই বরং বিএনপি এতে যুক্ত হলে তা আওয়ামী লীগকে সাহায্য করবে বলেই মনে করেন, এই রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। তিনি বলেন, এটার কোনো ইমপ্যাক্ট নেই। স্যাংশন বা বয়কট কোনো কাজে দেয় না। বরং তারাই উপকৃত হয়। এটা যেমন আওয়ামী লীগকেই হেল্প করবে।

এদিকে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেতারা কেন স্ত্রীদের ভারতীয় শাড়ি পোড়াচ্ছেন না, এমন প্রশ্ন তোলেন।

সেই প্রশ্নের উত্তরে রিজভী বলেন, বিএনপির নেতারা ইন্ডিয়া থেকে শাড়ি খুব একটা কেনে না। আমার নানাবাড়ি ভারতে। বিয়ের পর একবার ভারত গিয়েছিলাম মামাবাড়ি। সেখান থেকে আমার স্ত্রীকে একটা শাড়ি দিয়েছিল। সেটা অনেক আগেই কাথা বানানো হয়েছে, সেটাও ছিড়ে গেছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতকে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে বেশি মূল্যায়ন করা হয়েছে। বামপন্থি দলগুলো বেশি এই মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু আজকে হঠাৎ করে মনে হচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলাই যেন পাপ। নিজের দেশের কারখানায় শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যের কাছে নতজানু হওয়া যাবে না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম যাতে আরো বেড়ে যায়, সেজন্যই ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।

বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের বিরোধিতার নামে দেশের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে তুলছে বিএনপি। তারই নতুন সংস্কার ভারত বিরোধিতা। নিত্যপণ্যের দাম যাতে আরো বৃদ্ধি পায়, সেজন্যই তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের কর্মসূচি শুরু করেছে।

আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিএনপি কখনোই দেশের মানুষের ভালো চায় না। মানুষ শান্তিতে থাকুক- তারা এটা চায় না। জন্মলগ্ন থেকেই তারা দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড করছে, মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কাজ করছে আর ভারত বিরোধিতা তাদের তেমনই কর্মসূচি।