বদর যুদ্ধ মিথ্যার উপর সত্যের জয়

প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

কুরাইশ বাহিনী আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর প্রান্তরে একটি ছোট্ট কূপের ধারে অবস্থান নিলেন। খাব্বাব (রা.) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহতায়ালা আমাদের এমন এক স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন, যদি লড়াই করতে হয় তো কোনো অবস্থাতেই এই স্থানে ত্যাগ করবেন না। আমরা আপনার জন্য খেজুরপাতা আর লাকড়ি দিয়ে একটি ছাউনি তৈরি করছি। একটি চৌবা”চা খনন করে পানি তুলে তা ভর্তি করে নি”িছ, যাতে যুদ্ধ চলাকালে কূপ থেকে পানি তোলা আর বহন করে আনার ঝামেলা পোহাতে না হয়। নবী করিম (সা.) এই প্রস্তাবটি পছন্দ করলেন। সাহাবায়ে কেরাম কিছুক্ষণের মধ্যে একটি চৌবা”চা খনন করে পানি ভর্তি করে ফেললেন। মশকগুলোও পানিভর্তি করে পুরো কূপটি নিজেদের দখলে নিয়ে নিলেন।

কুরাইশ বাহিনী ওই এলাকায় আসার পর অদূরে অবস্থান নিল। মুসলমানদের পর্যবেক্ষণের জন্য তারা উমাইর নামক এক ব্যক্তিকে পাঠাল। উমাইর ইসলামী বাহিনীর চারদিকে চক্কর দিয়ে মুশরিক বাহিনীর কাছে প্রতিবেদন জানাল। মুহাম্মদের সাহাবীদের সংখ্যা ৩১৩ জন। তাদের সঙ্গে আছে দু’জন অশ্বারোহী (যুবাইর ও মিকদাদ)।

রিপোর্ট শুনে হাকিম ইবনে হাযাম ও উতবা ইবনে রবিআ মুসলমানদের সংখ্যা ক্ষুদ্র জ্ঞান করে কুরাইশ বাহিনী নিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে চাইল। কিš‘ আবু জেহেল তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করল, মক্কার মুশরিকরাও আবু জেহেলের প্রতি সমর্থন জানাল। সিদ্ধান্ত হলো যুদ্ধ হবে। উভয় দল যুদ্ধের প্র¯‘ত নিল।

নবী করিম (সা.) মুসলমানদের রণাঙ্গণে মোতায়েন এবং ব্যুহ রচনা করলেন। তারপর আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে তার জন্য প্র¯‘তকৃত ছাউনিতে ফিরে এলেন। ছাউনিতে বসে দোয়া করতে লাগলেন, ইয়া আল্লাহ! যদি মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র দল ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর বুকে তোমার ইবাদত করার লোক থাকবে না। আল্লাহ তুমি আমাকে যা দেয়ার ওয়াদা করেছ তা আমাকে দান কর। আবু বকর সিদ্দিক পেছন থেকে আমিন আমিন বলছিলেন।

সাআদ ইবনে মুআয (রা.) কয়েক জন্য আনসার তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ছাউনি ঘরের দরজায় পাহারা দি”িছলেন। দোয়া করতে করতে নবীজি কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেলেন। অতপর হঠাৎ আওয়াজ করে বললেন, ‘আবশির ইয়া আবা বকর, ফক্বদ আতা নসরুল্লাহ’। ‘হে আবু বকর! সুসংবাদ নাও। নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে।’ এরপর নবীজি বেরিয়ে এলেন এবং লোকদের যুদ্ধের জন্য উৎসাহ দিলেন। তিনি এক মুঠ কঙ্কর হাতে নিয়ে ‘শাহাতিল উজুহ’ পড়ে মুশরিকদের দিকে নিক্ষেপ করলেন।

প্রথমে মল্ল যুদ্ধ। মুশরিক বাহিনীর মাঝ থেকে উতবা, শায়বা ও ওয়ালীদ রণাঙ্গণে অবতীর্ণ হয়ে চিৎকার দিয়ে মল্লযুদ্ধের প্রতিপক্ষ আহ্বান করল। তাদের মোকাবিলার জন্য আনসারদের মাঝ থেকে আফরার দুই ছেলে মুআজ, মুআউওয়াজ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। মুশরিকরা পরিচয় জানতে চাইল, তোমরা কারা। জবাব দিল, আমরা আনসার। মুশরিকরা চিৎকার দিয়ে বলল, তোমাদের (মত পুচকে যোদ্ধার) সাথে আমরা লড়াই করব না। একজন চিৎকার দিয়ে বলল, হে মুহাম্মদ! আমাদের স্বজাতির মাঝ থেকে আমাদের প্রতিপক্ষ হওয়ার মতো যোগ্য লোক পাঠাও। তখন নবী করিম (সা.) উবায়দা (রা.), হামজা (রা.) ও আলী (রা.)-কে রণাঙ্গণে পাঠালেন। হামজা (রা.) তার প্রতিপক্ষ শায়বা ও আলী (রা.) তার প্রতিপক্ষ ওয়ালীদকে প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী করলেন। ওদিকে ওতবা উবায়দা (রা.) এর উপর আঘাত করল। তাতে তার পা কাটা গেল। হামযা ও আলী উতবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করলেন এবং উবায়দা (রা)-কে শিবিরে নিয়ে আসলেন। এরপর শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক তুমুল যুদ্ধ। ঘোরতর যুদ্ধ চলাকালে মুসলমানদের পক্ষে আসমানী ফেরেশতারা অবতীর্ণ হন। তারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে মুশরিকদের বড় বড় সর্দার উতবা, শায়বা, ওয়ালীদ, হানযালা, আসী, হারাস, তাঈমা, যামআ, আকীল, নওফল, আবু জেহেল নিহত হল।

আফরার দুই কিশোর ছেলে মুয়াজ ও মুআউওয়াজ যৌথভাবে আবু জেহেল এর উপর আঘাত হানে। এতে সে ধরাশায়ী হলে আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ (রা.) তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করেন। মোট ৭০ জন মুশরিক নিহত ও অপর ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। মুসলমানদের পক্ষে মোট শহীদ হন ১৪ জন। ৬ জন মুহাজির আর ৮ জন আনসার।

যুদ্ধ শেষে নবী করিম (সা.) নিহত মুশরিকদের লাশ একত্রে একটি কুয়ায় ফেলে মাটি চাপা দেন। শহীদ মুসলমানদের আলাদাভাবে দাফনের ব্যব¯’া করেন। যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মাল দেখাশোনার দায়িত্ব দেন আব্দ ইবনে কা’ব এর উপর। ফেরার পথে সাফরায় পৌঁছে তিনি গণিমতের মাল ভাগ-বাটোয়ারা করেন। এভাবে বন্দিদের সঙ্গে নিয়ে একেক মনযিল অতিক্রম করে বিজয় বেশে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন।

বলছিলাম, বদর যুদ্ধের প্রত্যেকটি বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে কোরআন মজিদে। যুদ্ধের সব পরিকল্পনা যেন আল্লাহ পাকই গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। সূরা আনফালের একটি আয়াতের ভাষ্য এরূপ-

‘স্মরণ কর, তোমরা ছিলে উপত্যকার কাছে প্রান্তে এবং তারা ছিল দূর প্রান্তে আর উষ্ট্রারোহী (বাণিজ্য) দল ছিল তোমাদের অপেক্ষা নিম্নভূমিতে (লোহিত সাগর তীরে)। যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইতে, তবে এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটত। কিš‘ যা ঘটবার ছিল আল্লাহ তা সম্পন্ন করলেন। যাতে যে কেউ ধ্বংস হবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে, সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর জীবিত থাকে। আল্লাহ তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

-(সূরা আনফাল, আয়াত-৪২)