এবারের ঈদে আশঙ্কা নেই শ্রমিক অসন্তোষের

বেতন-বোনাস দেয়ার নির্দেশ শ্রম প্রতিমন্ত্রীর

প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে পোশাক খাতের শ্রমিকরা। বৈদেশিক অর্থ আয়ের পাশাপাশি মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে এগিয়ে নিচ্ছে পোশাক খাত। প্রত্যেক বছরে ঈদুল ফিতরের আগমুহূর্তে বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করত দেখা যায় শ্রমিকদের। এবার ঈদুল ফিতরে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে রাস্তায় বিশৃঙ্খলার দৃশ্য দেখতে চায় না সরকার। শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে গার্মেন্টস মালিকদের নির্দেশনা দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে গত বুধবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তৈরি পোশাক খাতসংক্রান্ত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের সভা শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে গার্মেন্টস মালিকদের শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করতে হবে। ঈদের আগে কারখানাগুলো কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করতে পারবে না। এ জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অতীতে ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও গত কয়েক বছর সেটি করা হয়নি। এ বিষয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়নি। কোনো শিল্পের মালিক কখন দিতে পারবেন, কখন দিতে পারবেন না, সেটা তো আমরা জানি না। আমরা বলেছি, ঈদের ছুটির আগে দিতে হবে। এটা আমাদের কড়া নির্দেশনা।

ঈদ সামনে রেখে পোশাক খাতে কোনো শ্রমিক অসন্তোষ ঘটবে না, উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা কোনো বিশৃঙ্খলা বা ভাঙচুর চাই না। এরই মধ্যে শ্রমিকদের অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতসংক্রান্ত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের সভার দুই দিন পর ২২ মার্চ রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (জি-স্কপ)। আয়োজিত সমাবেশে ২০ রোজার ভেতর পূর্ণাঙ্গ বেতন-বোনাস প্রদানসহ মজুরি আন্দোলনে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, হয়রানি বন্ধ, ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন, শ্রমিক ছাঁটাই ও নির্যাতন বন্ধের দাবি জানানো হয়। সংগঠনের যুগ্ম সমন্বয়ক নাইমুল আহসান জুয়েলের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন শ্রমিক নেতা কামরুল আহসান, আব্দুল ওয়াহেদ, আহসান হাবিব বুলবুল, রুহুল আমিন ও সাইফুল ইসলাম।

বক্তারা বলেন, প্রতি বছরই শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ২০ রোজার মধ্যেই বকেয়া বেতন ও পূর্ণ বোনাস পরিশোধ করার দাবি জানানো হলেও মালিকপক্ষের একটি অংশ সময়ক্ষেপণ করে। এমনকি বকেয়া ও পূর্ণ বোনাসের পরিবর্তে বেতনের টাকা কমিয়ে ও বোনাসের নামে বকশিস নামক একটা কিছু দিয়ে গার্মেন্টস সেক্টরে অরাজকতা তৈরি করে। গত ২০ মার্চ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বকেয়া বেতন ও বোনাস পরিশোধে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা ছাড়া সাধারণভাবে ঈদের আগে পরিশোধ করার কথা বলা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে মালিকপক্ষকে সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সরকার ঘোষিত ১২ হাজার ৫০০ টাকার ন্যূনতম মজুরি শ্রমিকরা প্রত্যাখ্যান করলেও সেই ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করছে। ঈদকে ঘিরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় বোনাস দেয়ার নিয়ম আছে। যেসব শিল্প-কারখানাগুলো বেতন ও বোনাস পরিশোধে সমস্যায় পড়তে পারে এর তালিকা করেছে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ। সেই তালিকায় আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটের ৪১৬টি কারখানায় সমস্যা হতে পারে। সেজন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ। গার্মেন্টস মালিকরা ঈদ সামনে রেখে যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে তাদের পাওনা প্রণোদনা ছাড়ের অনুরোধও করা হয়েছে। কারণ কোনো কারখানা বেতন দিতে ব্যর্থ হলে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয় সরকার। সরকারের নির্ধারিত তহবিল থেকেও সহায়তা দেওয়া হয়। গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করে এসব সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকরক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, দেশের কারখানাগুলোয় কোনো ধরনের সমস্যা আছে, সেসব চিহ্নিত করতে একটা ফরম্যাট পাঠানো হয়েছে। যাতে সমস্যা সমাধান করা যায়। ব্যাংকগুলো যাতে তাদের সাপোর্ট ও সুবিধা দেয় সেজন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রণোদনা বাবদ প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সাধারণত ঈদের আগে তারা এগুলো রিলিজ করে।

তিনি বলেন, কয়েকদিন আমরা প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরি মনিটর করব, যাতে ঈদের আগে সবাই বেতন-বোনাস দিতে পারে। শেষ মুহূর্তে সমঝোতার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যাতে সমস্যা সমাধান করা যায়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ব্যাংক থেকে লোন করার ব্যবস্থাও করি। আবার বিজিএমইএ থেকেও সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আবার বায়ারের পেমেন্ট বা কোনো পার্টির কাছে বকেয়া টাকা রয়েছে কি না, সব বিষয় আমলে নিয়েই সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক সানা সামিনুর রহমান বলেন, ঈদের আগমুহূর্তে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে যাতে সমস্যা না হয়, সে জন্য আগে থেকে সতর্ক করা হয়েছে। প্রোঅ্যাকটিভ অ্যাকশন হিসেবে যাতে করে ঈদের আগে বেতন না পেয়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে না হয়, তাই সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের শিল্প-কারখানার প্রসার ঘটেছে। আর এসব কারখানা কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র হোক, সেটি কখনই কাম্য নয়। সেজন্য আগেভাগেই কারখানার মালিক, শ্রমিক প্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ত্রিমুখী বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। কারখানাগুলো এখন একটি নিয়মনীতির মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতা সংগঠন ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নজরদারিও রয়েছে। আবার কেউ যাতে শ্রমিকদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারেও সজাগ রয়েছে সরকার। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গার্মেন্টসগুলোর বিশৃঙ্খলার কোনো সুযোগ নেই। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কারখানাগুলোর মালিক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এগিয়ে যাচ্ছেন।