ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

২০ রমজান মক্কা বিজয়ের স্মরণি

২০ রমজান মক্কা বিজয়ের স্মরণি

২০ রমজান ঐতিহাসিক মক্কা বিজয় দিবস। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই তারিখে পবিত্র মক্কা নগরী জয় করেন। বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। মক্কার কুরাইশ মুশরিকরা আত্যাচার নির্যাতনের মুখে মহানবী ও মুসলমানদের জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল।

মুসলামনরা মদিনায় এসে ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করলেও এক মুহূর্তও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারেননি। বদর, উহুদ, খন্দক যুদ্ধে কুরাইশ নেতৃত্বাধীন গোটা আরব শক্তিসমূহের সাথে কয়েকবার লড়াই করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুই বছর আগে ষষ্ঠ হিজরীতে মুসলমান ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়।

দৃশ্যত মুসলমানদের জন্য অবমাননামূলক এই চুক্তির একটি শর্ত ছিল আরবের যে কোনো গোত্র ইচ্ছা করলে কুরাইশ বা নবীজির সাথে মৈত্রি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে এবং চুক্তিবদ্ধ কোনো গোত্রের ওপর অপর পক্ষ আক্রমণ করতে পারবে না।

হুদাইবিয়ার সন্ধির পর পুরো আরবে শান্তির সুবাতাস বয়ে যায়। আরব গোত্রগুলো ইসলামের ছায়তলে আশ্রয় নিতে থাকে। কুরাইশ নেতারা শংকিত হয়ে পড়ে যে, এ অবস্থা চলতে থাকলে গোটা আরব মুসলমানদের করায়ত্বে চলে আসবে। ফলে তারা ১০ বছর মেয়াদি হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করার চিন্তা করতে থাকে।

কুরাইশদের প্রতিবেশী দুটি গোত্র ছিল খোজাআ ও বনু বকর। তাদের মধ্যে চরম শত্রুতা ছিল দীর্ঘদিনের। বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। আত্মরক্ষার জন্য খোজাআ গোত্র মৈত্রিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল মহানবী (সা) এর সঙ্গে।

একবার অতর্কিতে বনু বকর গোত্র বনু খোজাআ গোত্রের উপর আক্রমণ ও নির্মম হত্যাকান্ড চালায়। কুরাইশরা গোপনে সেই হত্যাযজ্ঞে মদদ জোগায়। পরক্ষণে বুঝতে পারে মুসলমানদের সাথে চুক্তিবদ্ধ খোজাআ গোত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়ে হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেছে। পরিস্থিতির নাজুকতা আঁচ করতে পেরে কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি নবায়ন করার উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে খোজাআ গোত্রের ৪০ জন অশ্বারোহী মদিনায় গিয়ে তাদের চরম দুর্দশার কথা জানায় এবং সাহায্য চায়। নবীজি তাদের সাহায্যের আশ্বাস দেন। কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান চুক্তি নবায়নের উদ্দেশ্যে মদিনায় আসার পথে খোজাআ গোত্রের লোকজনের সাথে দেখা হয়। মদিনায় এসে আবু সুফিয়ান উম্মে হাবিবার ঘরে যান। উম্মে হাবিবা আবু সুফিয়ানের মেয়ে; তবে তিনি মুসলমান এবং মহানবী (সা.) এর অন্যতম স্ত্রী, মুমিনদের মা। আবু সুফিয়ান মেয়ের বিছানায় বসতে চাইলে তিনি বিছানা গুটিয়ে নেন। আবু সুফিয়ান এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন, এটি রাসুলুল্লাহর বিছানা। এর ওপর কোনো নাপাক মুশরিক বসতে পারে না। কথা শুনে আবু সুফিয়ান বলল, তোমাকে দেখছি অশুভ চক্র পেয়ে বসেছে। এ কথা বলে, মসজিদে নববীতে চলে আসে। সরাসরি নবীজির কাছে গিয়ে চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব উত্থাপন করে। নবীজি কোনো জবাব দিলেন না। আবু সুফিয়ান আবু বকর, উমর ও আলী (রা.)-এর কাছে গিয়ে সুপারিশ করার অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে মক্কায় ফিরে যায়।

আবু সুফিয়ানের বিদায়ের পর নবীজি অতি গোপনে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিতে থাকেন। যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর যাতে মক্কায় বা মুশরিকদের কাছে না যায়, সে ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন। এরই মধ্যে একটি ঘটনা সামনে আসে। হাতেব ইবনে আবি বালতা নামক একজন সাহাবী মক্কাগামী এক মহিলার কাছে গোপনে একটি চিঠি দেন। নবীজি ওহি যোগে ব্যাপারটি জানতে পারেন। হযরত আলী, যুবাইর ও মিকদাদ (রা.)-কে পাঠান মহিলার কাছ থেকে চিঠিখানা উদ্ধার করার জন্য।

তারা অশ্ব দাবড়িয়ে মহিলাকে পেয়ে যান এবং তল্লাশি চালান। মহিলা প্রথমে চিঠির কথা অস্বীকার করলেও পরে মাথার চুলের বেণি থেকে একটি চিঠি বের করে দেয়। হাতেব ইবনে বালতার কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়। তিনি অকপটে স্বীকার করেন, তিনি মনেপ্রাণে মুসলমান; তবে মক্কায় আটকে পড়া তার আত্মীয় স্বজনদের কুরাইশরা সুনজরে রাখবে- এই আশায় চিঠিখানা লিখেছেন। উমর (রা.) নবীজির কাছে বললেন, এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেয়ার অনুমতি দিন। নবীজি বললেন, বদর যুদ্ধে যারা অংশ গ্রহণ করেছিল, তারা আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমাপ্রাপ্ত।

অষ্টম হিজরির ১০ রমজান মহানবী (সা.) ১০ হাজার সঙ্গীসহ মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে তার চাচা আব্বাস ইসলাম গ্রহণ করে মক্কা থেকে এসে কাফেলার সাথী হন। মররুজ জাহরান এলাকায় পৌঁছে নবীজি শিবির স্থাপন করেন। রাতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বের হয়ে আবু সুফিয়ান দেখে, মক্কার উপকণ্ঠে বিশাল প্রান্তরজুড়ে থোকা থোকা আগুন জ্বলছে। রাতের আঁধারে দেখামাত্র তাকে আব্বাস (রা.) নিরাপদে নবীজির সামনে হাজির করেন। একদিন পর আবু সুফিয়ান অগত্যা ইসলাম গ্রহণ করে।

আব্বাস (রা.) এর প্রস্তাবক্রমে নবীজি তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে বলেন, মক্কা অভিযানে যারা অস্ত্র ফেলে দেবে তাদের জীবন নিরাপদ। যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও নিরাপদ। চারদিক থেকে মহানবীর সাঁজোয়া বহর মহা সমারোহে মক্কায় প্রবেশ করে। তিন দিক থেকে কোনো বাধা না এলেও একদিকে বাধা আসে। সামান্য যুদ্ধ হয় ১২ জন কাফের নিহত ও দুজন মুসলমান শহিদ হন। নবীজি কাবাঘরে প্রবেশ করে দেব-দেবির মূর্তিগুলো অপসারণ করেন। কাবাঘরের পবিত্রতা এবং মক্কাবাসীর উদ্দেশে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। বিজয় লাভের পর শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়ার এই দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এরপর থেকে আরবের আনাচে কানাচে ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে লোকজন ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে। মক্কা বিজয়ের অবিস্মরণীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ২০ রমজান অষ্টম হিজরি সালে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত