আট বছর পর ইফতার পার্টি

রক্তস্নাত স্বাধীনতার মাসে জামায়াতের আস্ফালন!

ফের এক টেবিলে বিএনপি-জামায়াত

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

রক্তস্নাত স্বাধীনতার মাসে ফের আস্ফালন দেখাল জামায়াত। দীর্ঘ নয় বছর পর ইফতার মাহফিলের নামে ঐক্যবদ্ধ হলো স্বাধীনতাবিরোধীরা। জামায়াতের কর্মকাণ্ডে সায় দিয়েছে দলটির দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি। জামায়াতের সক্রিয়তায় রাজনীতির মাঠে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত ফের জনগণের জানমালের ওপরে হামলা চালাতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তাদের মতে, রাজনীতির মাঠে জামায়াতের সক্রিয় হওয়ার অর্থ হচ্ছে নতুন করে সহিংসতার ইঙ্গিত। জামায়াতের দোসর হচ্ছে বিএনপি। রাজনীতির মাঠে এরা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিএনপি-জামায়াত অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করে।

জানা যায়, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর থেকে দীর্ঘদিনের মিত্র ও জোট সঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ার কথা জানায় বিএনপি। এরপর বিভিন্ন সময়ে এই দুই দলের শীর্ষ নেতারা পারস্পরিক বাকযুদ্ধেও জড়ান। এক পর্যায়ে জামায়াতকে নিয়ে গঠিত ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয় বিএনপি। এরপর থেকে দল দুটির নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কাছাকাছি হতে দেখা যায়নি। তবে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে দুটি দল দূরত্ব দেখালেও বাস্তবে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বিএনপির।

সূত্র জানায়, অনেক আগে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দলটি দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে রাজনীতি থেকে বিরত ছিল। তবে চুপিসারে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে দলটি। প্রায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে নিজেদের কর্মসূচি জানান দেয় জামায়াত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে আসতে থাকে জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা। বিএনপির কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে। নির্বাচনের সময় জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি পালন করে। আবার ভোটের পর চুপসে যায়।

স্বাধীনতার মাসে ফের নিজেদের অবস্থা জানান দিয়েছে জামায়াত। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। সর্বশেষ ২০১৫ সালে দলটির ইফতারে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জামায়াত নেতারা মুখোমুখি বসেছিলেন। দ্বাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপি যখন আন্দোলনের নামে মাঠে নেমেছিল ঠিক তখনও সঙ্গে জামায়াত আছে কি নেই, তার স্পষ্ট কোনো উল্লেখ করেনি দলটি।

গত শনিবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে প্রায় আট বছর পর রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে ইফতার করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দল দুটির নেতাদের একসঙ্গে আবারো ইফতারের টেবিলে বসাকে তাদের পুরোনো সম্পর্কে নতুন পথচলা বলে মনে করছেন অনেকে। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা জামায়াতে অন্তর্ভুক্তি না চাওয়ার কারণে এতদিন প্রকাশ্য সম্পর্ক নিয়ে খোলাসা করে কিছু বলেনি বিএনপি। আবারও নতুন করে আন্দোলন শুরু করার লক্ষ্যে ইফতার আয়োজনের মধ্য দিয়ে পুরোনো শরিকের সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করে নেওয়ার কৌশল হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এরআগে রাজধানীর লেডিস ক্লাবে গত বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে বিএনপি। বিএনপির এই ইফতার মাহফিলে জামায়াতে ইসলামীর আমিরসহ দলটির চারজন নেতা অংশ নিয়েছেন। তবে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের দুই শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেউ অংশ নেননি।

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ।

গত বছর বিএনপির ইফতারে জামায়াতকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। এবার ইস্কাটন গার্ডেনে লেডিস ক্লাবে বিএনপির ইফতারে জামায়াতের আমিরসহ শীর্ষ চার নেতা যোগ দেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

গত শনিবার জামায়াতের ইফতারে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও জয়নাল আবেদিন। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সালাম, মাসুদ আহমেদ তালুকদার। যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সারওয়ার, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল, দলটির মিডিয়া সেলের জহির উদ্দিন স্বপন ও শায়রুল কবির খানও যান ইফতার পার্টিতে। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিনা সংগ্রামে কখনো মুক্তি আসে না। সকল বাধা ও শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে হলে এ জাতিকে আরেকটিবার শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা সকলের মঙ্গল কামনা করি। সকল রকম হঠকারিতা ও বিশৃঙ্খলা পরিহার করতে হবে। পায়ে পারা দিয়ে কেউ ঝগড়া করতে আসলে অবশ্যই তার জবাব দিতে হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, জামায়াত এখন জনসংযোগ হবে এমন নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচির দিকেই বেশি আগ্রহী হবে। তিনি বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে হয়তো তারা এমন কর্মসূচিই হাতে নেবে যেখানে মানুষের কাছে যাওয়া যায় এবং একই সাথে বিএনপিকেও আশ্বস্ত করা যাবে যে সরকারবিরোধী আন্দোলনেও আছি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন, যা পরবর্তী সময়ে আপিল হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর দলটির পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল (সিপি) করা হয়। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদিকে আন্দোলনের ব্যর্থতায় বিপর্যস্ত নেতাকর্মীকে চাঙ্গা রাখতে উপজেলা নির্বাচনে যাবে জামায়াতে ইসলামী। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা দিয়ে নয়, স্থানীয়ভাবে প্রার্থী হবেন দলটির নেতারা। এরইমধ্যে উপজেলা নির্বাচন সামনে রেখে আবার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলীয় প্রতীক না থাকায় স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে যশোরের আটটি উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ইতিমধ্যে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটি। সম্ভাব্য প্রার্থীরা পোস্টার, লিফলেট ও গণসংযোগের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।