ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোরআন তেলাওয়াত ও শিক্ষাদান

কোরআন তেলাওয়াত ও শিক্ষাদান

একটা প্রচারণায় অনেক সময় আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। বলা হয় যে, কোরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করাই মূল উদ্দেশ্য। কোরআন বুঝা, শিক্ষা দেয়া ও গ্রহণ করা না হলে তেলাওয়াতে কোনো ফযিলত বা লাভ নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞ আলেমদের মত হলো, কোরআন শিক্ষা করা যেমন ইবাদত ও সওয়াবের কাজ, কোরআন তেলাওয়াত করাও স্বতন্ত্রভাবে সওয়াবের কাজ। কারণ, আল্লাহ পাক নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়ায় পাঠানোর পেছনে তিনটি উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেছেন সূরা বাকারার ১২৯নং আয়াতে। ‘তিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের আত্মিক ও চারিত্রিকভাবে পরিশুদ্ধ করবেন।

লক্ষ্য করুন, তেলাওয়াতের সম্পর্ক শব্দের সাথে এবং শিক্ষাদানের সম্পর্ক অর্থের সাথে। তেলাওয়াত ও শিক্ষাদান পৃথক পৃথকভাবে বর্ণিত হওয়ার মর্মার্থ হলো, কোরআন অর্থসম্ভার যেমন উদ্দেশ্য, শব্দসম্ভারও তেমনি স্বতন্ত্রভাবে বিবেচ্য। শিক্ষাদান বা হেদায়াতের মতো তেলাওয়াতও ফরজ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহে কোরআনের সংজ্ঞা এভাবে বর্ণিত হয়েছে : শব্দসম্ভার ও অর্থসম্ভার উভয়ের সমন্বিত গ্রন্থের নামই কোরআন। মোটকথা, আয়াতে কোরআন তেলাওয়াতকে কোরআন শিক্ষাদান থেকে পৃথক করে একটি উদ্দেশ্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোরআনের অর্থসম্ভার যেমন উদ্দেশ্য, শব্দসম্ভারও তেমনি উদ্দেশ্য। কেননা, তেলাওয়াত করা হয় শব্দের, অর্থের নয়। অতএব, অর্থ শিক্ষা দেয়া যেমন পয়গাম্বরের কর্তব্য, তেমনি শব্দের তেলাওয়াত এবং সংরক্ষণও তার একটি স্বতন্ত্র কর্তব্য ও দায়িত্ব। কোরআনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা এবং তার বিধি-বিধান পালন করা যেমন ফরজ ও উচ্চস্তরের ইবাদত, তেমনিভাবে তার শব্দ তেলাওয়াত করাও একটি স্বতন্ত্র ইবাদত ও সওয়াবের কাজ। তাই অর্থ না বুঝে কোরআনের শব্দ পাঠ করা নিরর্থক নয়; বরং সওয়াবের কাজ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম কোরআনের অর্থ সম্পর্কে সমধিক জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু উপরোক্ত কারণেই তারা শুধু অর্থ বুঝা ও তা বাস্তবায়ন করাকেই যথেষ্ট মনে করেননি। বুঝা এবং আমল করার জন্য একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট ছিল; কিন্তু তারা সারা জীবন কোরআন তেলাওয়াতকে অন্ধের যষ্টি মনে করতেন। কতক সাহাবী দৈনিক একবার কোরআন খতম করতেন, কেউ দুই দিনে এবং কেউ তিন দিনে, কেউ সাত দিনে কোরআন খতমে অভ্যস্ত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও ছাহাবায়ে কেরামের এ কার্যধারাই প্রমাণ করে যে, কোরআনের অর্থ বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা যেমন ইবাদত, তেমনিভাবে শব্দ তেলাওয়াত করাও স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে একটি উচ্চস্তরের ইবাদত এবং বরকতময়। আর তা সৌভাগ্য ও মুক্তির উপায়। এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কর্তব্যসমূহের মধ্যে কোরআন তেলাওয়াতকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মোটকথা, রাসুলের কর্তব্য বর্ণনা প্রসঙ্গে কোরআন তেলাওয়াতকে স্বতন্ত্র কর্তব্যের মর্যাদা দিয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছে যে, কোরআনের শব্দ তেলাওয়াত, শব্দের সংরক্ষণ এবং যে ভঙ্গিতে তা অবতীর্ণ হয়েছে, সে ভঙ্গিতে তা পাঠ করা একটি স্বতন্ত্র ফরজ। (মাআরেফুল কুরআন ১খ. পৃ-৩৮৩ অবলম্বনে)

এ সম্পর্কে হাদিস শরিফের ভাষ্য আরো স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট।

‘তোমাদের মধ্যে সে-ই শ্রেষ্ঠ, যে কোরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা দেয়।’ (মিশকাত, হাদিস নং-২০০৭)

‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করেছে এবং তাতে যা আছে তার সাথে আমল করেছে, তার মাতাপিতাকে কিয়ামতের দিন এমন একটি তাজ পরানো হবে, যার কিরণ সূর্যের কিরণ অপেক্ষাও উজ্জ্বল হবে, যদি সূর্য তোমাদের দুনিয়ার ঘরে তোমাদের মধ্যে থাকত।’ (আহমদ ও আবু দাউদ, মিশকাত, হাদিস নং-২০৩৬)

‘কোনো ব্যক্তির মাসহাফ (অর্থাৎ দেখে পড়া) ব্যতীত মুখস্ত কোরআন পড়া এক হাজার মর্যাদা রাখে, আর তা মাসহাফে (অর্থাৎ দেখে) পড়া মুখস্ত পড়ার দুই গুণ- দুই হাজার পর্যন্ত মর্যাদা রাখে।’ (মিশকাত, হাদিস নং-২০৬৩

‘কোরআন পাকে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে থাকবেন, আর যে কোরআন পড়ে ও তাতে আটকায় এবং কোরআন তার পক্ষে কষ্টদায়ক হয় তার জন্য দুটি পুরস্কার রয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-২০১০)

‘কোরআন পড় যতক্ষণ তোমাদের মন তা সাগ্রহে চাহে আর যখন মনের ভাব অন্যরূপ দেখ, তা ছেড়ে উঠে যাও।’ (বুখারি ও মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-২০৮৬)

‘প্রকাশ করে কোরআন পাঠকারী প্রকাশ্যে খয়রাতকারীর ন্যায় আর চুপে কোরআন পাঠকারী চুপে খয়রাতকারীর ন্যায়। সুতরাং কোরআন তেলাওয়াত চুপে করাই উত্তম।’ (মিশকাত, হাদীস নং-২০৯৮)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত