কিশোর গ্যাং

ধামরাইয়ে আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং : নেই গ্রেপ্তার

প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিনিধি

দেশে এখন আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। তুচ্ছ ঘটনায় এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ছে। এই কিশোর গ্যাংয়ের পরিধি শহর থেকে এখন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে। ১২-২৫ বছর বয়সের ছেলেরা এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এদের এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠরাও ভয় পায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রামগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য অপ্রতিরোধ্য। দ্রুত গতিতে এই কিশোর গ্যাং কালচারের সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছে, বাড়ছে। দেশের কোনো কোনো এলাকায় এসব কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুন করা হচ্ছে। ঘরবাড়ি ভাঙচুরও করা হচ্ছে। গ্যাং সদস্যদের হুমকি হচ্ছে- বেশি রাগে করা হবে খুন আর কম রাগে পঙ্গু। ঢাকা-চট্টগ্রামে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি ঢাকার ধামরাই থানার চররাজাপুর গ্রামে গ্যাং লিডার মিজান ও লাবুর নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য নাজমূল হক নয়ন ওরফে নয়া মিয়া, রফিকুল ইসলাম কিতু, মোবারক হোসেন পাগলা ওরফে ডাকাত পাগলা, কাইয়ুম হাসান লিখন, ওরফে শিবির লিখন, রাব্বি ইসলাম রোমা, ইমরান হোসেন রতন ওরফে শিবির রতন, রোকন মিয়া, খোরশেদ মিয়া ওরফে ছ্যানা খোরশেদসহ আরও অজ্ঞাত কয়েকজন দুইজন নারীসহ পাঁচজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে রাস্তায় ফেলে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গ্যাং লিডার মো. মিজানুর রহমান সিদ্দিকী চাকরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে। তিনি দিনে ব্যাংকে চাকরি করেন রাতে কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেন এবং অপর গ্যাং লিডার তারই ছোট ভাই মো. লাবুবুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি চাকরি করেন ন্যাশনাল ব্যাংকে। তিনিও দিনে ব্যাংকে চাকরি করে রাতে অপর একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেন। ঘটনার বিবরণ দিয়ে আহত জিদান মাহিন জনি ও শাহীন জানান, কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসী দিয়ে ওই দুই গ্যাং লিডার মিজান ও লাবু ঘটনাস্থলে একটি মসজিদ নির্মাণকে কেন্দ্র করে এমন নৃশংস মারধরের ঘটনা ঘটায়। দুজন নারীকে রক্তাক্ত জখম করে। যা প্রচুর সেলাই লেগেছে। গ্রামের যে মসজিদ নির্মাণে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে সেটি আমাদের দাদা মোতাওয়াল্লি ছিলেন, তার আগে তার বাবা মরহুম মৌলভী ফজলুল করিম সিদ্দিকী ছিলেন। মসজিদটির নাম রাজাপুর মধ্য চেরাগী জামে মসজিদ। এটি সরকারি ওয়াক্ফ এস্টেট তালিকাভুক্ত। বিগত সময়ে একাধিকবার নদীর ভাঙনের কারণে মসজিদটি নদীতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘসময় পরে নদীর চর জেগে উঠলে এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি তৈরি শুরু করে। এমতাবস্থায় ওয়াক্ফ এস্টেট থেকে জানানো হয় রাজাপুর মধ্য চেরাগী জামে মসজিদের জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো জায়গায় এ মসজিদ নির্মাণ করা যাবে না। আমরা সে পরামর্শ মেনেই উল্লেখিত স্থানের জমিতে সব নিয়মকানুন মেনে আমার প্রবাসী বাবার দেওয়া টাকা দিয়ে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করতে গেলেই গ্যাং লিডারের টাকা নিয়ে ভূমি দখলে ওই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। প্রতিবাদ করায় উপস্থিত পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমি আমার উপর এমন নৃশংস বর্বর হামলা নির্যতনকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি করছি। সন্ত্রাসীরা কোনোভাবেই যেনো রেহাই না পায় তার জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এদিকে কিশোর গ্যাং সদস্যদের নির্যাতনের শিকার আহত নারী রিয়া বেগম জনি বাদী হয়ে ধামরাই থানায় গত ২৯ মার্চ ২০২৪ইং তারিখে মামলা দায়ের করেন। এতে মামলায় ১ নম্বর আসামি করা হয় গ্যাং লিডার মো. মিজানুর রহমান সিদ্দিকী, ২ নম্বর আসামি গ্যাং লিডার মো. লাবুবুর রহমান সিদ্দিকী, অন্য আসামিরা হলো কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য নাজমূল হক নয়ন ওরফে নয়া মিয়া, রফিকুল ইসলাম কিতু, মোবারক হোসেন পাগলা ওরফে ডাকাত পাগলা, কাইয়ুম হাসান লিখন, ওরফে শিবির লিখন, রাব্বি ইসলাম রোমা, ইমরান হোসেন রতন ওরফে শিবির রতন, রোকন মিয়া, খোরশেদ মিয়া ওরফে ছ্যানা খোরশেদসহ আরও অজ্ঞাত কয়েকজন। মামলা নং-৩১। ধারা-১৪৫/ ৪৪৭/ ১২৩/ ৩২৫/ ৩২৬/ ১০৭/ ৩৫৪/ ৩৭৯/ ১০৬/ ১১৪ পেনাল কোড ১৮৬০। থানা সূত্রে জানা গেছে মামলার আসামিরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। অপরাধ বিশেজ্ঞদের মতে কিশোর গ্যাং সদস্যরা ধরা পড়লে সংশোধনীতে পাঠানো প্রয়োজন এবং কঠোর শাস্তি পায় না বলেই বারবার কিশোর গ্যাং মাথাচারা দেয়। প্রজন্মের আপদ কিশোর গ্যাং, পুলিশি অভিযানেও লাগামছাড়া। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং কালচার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চালানো সত্ত্বেও এই চক্রের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন বাড়ছে এসব গ্যাংয়ের সংখ্যা ও দৌরাত্ম্য। আগে রাজধানীতে এসব গ্যাং সক্রিয় থাকলেও এখন সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় বিস্তার লাভ করছে। গত চার বছরের তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোররা এই অপকর্মে জড়িত ছিল। ইদানীং উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এতে যুক্ত হচ্ছে। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় খুব অল্প বয়সেই বখে যাচ্ছে তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বসে নেই। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা অভিযান চালাচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে ১৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের অধিকাশংই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের আটটি বিভাগে ১২৬টি কিশোর গ্যাংয়ের ৬৮ জন পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন। তাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের। এর মধ্যে রাজধানীতে পৃষ্ঠপোষকের তালিকায় চারজন কাউন্সিলর রয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রের তথ্য, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নানা কর্মকাণ্ডে দেশের বিভিন্ন থানায় ২০২৩ সালে ৩৬৬টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ৯০০ জনকে। র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের ১ হাজার ১২৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ২০২৩ সালে সারা দেশ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ৩৪৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।