ধৈর্য ও নামাজে যাবতীয় সংকটের প্রতিকার
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৩)
আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, যাবতীয় প্রয়োজন ও সমস্ত সংকটের নিশ্চিত প্রতিকার দুটি বিষয়ের মধ্যে নিহিত। একটি সবর বা ধৈর্য এবং অন্যটি নামাজ। যে কোনো প্রয়োজনেই এই দুটি বিষয়ের দ্বারা মানুষ সাহায্য লাভ করতে পারে। স্বতন্ত্রভাবে দুটি বিষয়েরই তাৎপর্য অনুধাবন করা যেতে পারে। সবর শব্দের অর্থ সংযম অবলম্বন ও নাফস এর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা। কুরআন ও হাদিসের পরিভাষায় সবর এর তিনটি শাখা রয়েছে। এক- নফস বা কুপ্রবৃত্তিকে হারাম এবং না-জায়েজ বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা।
দুই- ইবাদত ও আনুগত্যে বাধ্য করা এবং
তিন- যে কোনো বিপদ ও সংকটে ধৈর্য ধারণ করা। অর্থাৎ যেসব বিপদণ্ডআপদ এসে উপস্থিত হয়, সেগুলোকে আল্লাহর বিধান বলে মেনে নেয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা। অবশ্য কষ্টে পড়ে যদি মুখ থেকে কোনো কাতর শব্দ উচ্চারিত হয়ে যায়, কিংবা অন্যের কাছে তা প্রকাশ করা হয়, তবে তা সবরের পরিপন্থি হবে না- (ইবনে কাসীর, সায়ীদ ইবনে জুবায়র থেকে)
সবর এর উপরোক্ত তিনটি শাখাই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য পালনীয় তিনটি কর্তব্য। সাধারণ মানুষের ধারণায় সাধারণত তৃতীয় শাখাকেই সবর হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম দুটি শাখা যে এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে মোটেও লক্ষ্য করা হয় না। এমনকি এই দুটি বিষয়ও যে সবর এর অন্তর্ভুক্ত এ ধারণাও অনেকের নেই।
কুরআন হাদিসের পরিভাষায় ধৈর্যধারণকারী বা সাবের সেসব লোককেই বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেই সবর অবলম্বন করে থাকেন। কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে, হাশরের ময়দানে ঘোষণা করা হবে ধৈর্যধারণকারীরা কোথায়? একথা শোনার সংগে সংগে সেসব লোক উঠে দাঁড়াবে, যারা তিন প্রকারেই সবর করে জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। এসব লোককে প্রথমেই বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে। ইবনে কাসীর এ বর্ণনা উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন যে, কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-
‘সবরকারী বান্দাগণকে তাদের পুরস্কার বিনা হিসাবে প্রদান করা হবে।’ (সূরা যুমার : আয়াত-১০)
এ আয়াতে সেদিকেই ইশারা করা হয়েছে।
মানুষের যাবতীয় সমস্যা ও সংকট দূর করা এবং যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে কুরআনে উল্লিখিত দ্বিতীয় পন্থাটি হচ্ছে নামাজ। ‘সবর’ এর তফসির প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সর্বপ্রকার ইবাদতই সবরের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এরপরেও নামাজকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, নামাজ এমনই একটি ইবাদত, যাতে ‘সবর’ তথা ধৈর্যের পরিপূর্ণ নমুনা বিদ্যমান। কেননা, নামাজের মধ্যে একাধারে যেমন নফস তথা রিপুকে আনুগত্যে বাধ্য রাখা হয়, তেমনি যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ, নিষিদ্ধ চিন্তা, এমনকি অনেক হালাল ও মোবাহ বিষয় থেকেও সরিয়ে রাখা হয়। বস্তুত নিজের নফসের ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ, গোনাহ ও অশোভন আচার-আচরণ থেকে নিজকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও নিজেকে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে ‘সবর’ এর যে অনুশীলন করতে হয়, নামাজের মধ্যেই তার একটা পরিপূর্ণ নমুনা ফুটে উঠে।
যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করা এবং সর্বপ্রকার বিপদণ্ডআপদ থেকে মুক্তি লাভ করার ব্যাপারে নামাজের একটা বিশেষ তাছীর বা প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ বিশেষ রোগে কোনো কোনো ঔষধি গুল্মলতা ও ডাল শিকড় গলায় ধারণ করায়, মুখে রাখায় যেমন বিশেষ ফল লক্ষ্য করা যায়, লোহার প্রতি চুম্বকের বিশেষ আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক, কিন্তু কেন এরূপ হয় তা যেমন সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বলা যায় না; তেমনি বিপদমুক্তি এবং যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে নামাজের ‘তাছীর’ও ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এটা পরীক্ষিত সত্য যে, যথাযথ আন্তরিকতা ও মনোযোগ সহকারে নামাজ আদায় করলে যেমন বিপদমুক্তি অবধারিত, তেমনি যে কোনো প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারেও এতে সুনিশ্চিত ফল লাভ করা যায়।
হুজুর (সা.) এর পবিত্র অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন, তখনই তিনি নামাজ আরম্ভ করতেন। আর আল্লাহ তা‘আলা সে নামাজের বরকতেই তার যাবতীয় বিপদাপদ দূর করে দিতেন। হাদিস শরিফে আছে- মহানবী (সা.)-কে যখনই কোনো বিষয় চিন্তিত করে তুলত, তখনই তিনি নামাজ পড়তে শুরু করতেন।
নামাজ এবং সবরের মাধ্যমে যাবতীয় সংকটের প্রতিকার হওয়ার কারণ হচ্ছে, এ দুই পন্থায়ই আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত সান্নিধ্য লাভ হয়। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছে বাক্যের দ্বারা এদিকে ইশারা করা হয়েছে যে, নামাজী এবং সবরকারীগণের সাথে আল্লাহর সান্নিধ্য তথা খোদায়ী শক্তির সমাবেশ ঘটে। যেখানে বা যে অবস্থায় বান্দার সাথে আল্লাহর শক্তির সমাবেশ ঘটে, সেখানে দুনিয়ার কোনো শক্তি কিংবা কোনো সংকটই যে টিকতে পারে না, তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন করে না। বান্দা যখন আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান হয়, তখন তার গতি অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে যায়। তার অগ্রগমন ব্যাহত করার মতো শক্তি কারও থাকে না। বলা বাহুল্য, মকসুদ হাসিল করা এবং সংকট উত্তরণের নিশ্চিত উপায় একমাত্র আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান হওয়াই হতে পারে।
(মাআরেফুল কুরআন, ১খ. পৃ-৪৫৯ অবলম্বনে)