ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি দিলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা

প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি দিলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা

বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকালে বুয়েটে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সামনে চিঠিটি পড়ে শোনান তারা।

চিঠিতে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বুয়েটকে ছাত্র রাজনীতির বাইরে রাখুন, প্রয়োজনে আইন সংস্কার করে হলেও। কারণ, সুবিচারের জন্যই আইনের সৃষ্টি। আমাদের অনুরোধ, আপনি দয়া করে আমাদের ক্যাম্পাসে আসুন; ছাত্র রাজনীতিহীন বুয়েট গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের জন্য যে আদর্শ ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে, সেটা আমরা আপনাকে দেখাতে চাই।’ চিঠিতে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পাশাপাশি বুয়েট ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা রুখে দেয়ার কথা উল্লেখ করেন।

২০১৯ সাল থেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকার পর বর্তমান সময় শিক্ষার্থীরা অনেক নির্বিঘ্নে সময় কাটিয়েছেন উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বুয়েট ক্যাম্পাসে এই ৪ বছর আমরা নির্বিঘ্নে কাটিয়েছি, সেখানে ছায়া হয়ে ছিলেন আমাদের শিক্ষকরা। আমাদের মতো দেশজুড়ে লাখো শিক্ষার্থী এমন একটা ক্যাম্পাসের স্বপ্ন নিয়েই বাড়ি ছাড়ে যেখানে তাদের ওপর অকারণে জুলুম হবে না, নির্যাতিত হতে হবে না, দিন রাত কারো ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না, বাবা মাকে দুশ্চিন্তায় চোখের পানি ফেলতে হবে না। ৪ বছর আগে আপনার দৃঢ় এবং দ্রুত হস্তক্ষেপে আমরা নতুন করে এই ক্যাম্পাসে বাঁচতে শিখেছি।’

বর্তমানে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে অপদস্ত হচ্ছেন- উল্লেখ করে তারা বলেন, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই ছোট্ট একটা চাওয়ার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি হুমকি, হচ্ছি লাঞ্ছিত, অপদস্ত। আমরা আমাদের ছোট ভাই বোনেরা আরো একবার সেই অন্ধকার দিনগুলোর সাক্ষী হতে চাই না।’

ছাত্র রাজনীতি থাকাকালীন বুয়েট ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র‌্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনা এবং এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এর চরমতম মূল্য হিসেবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ’৯৯-এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল ’০৯ এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ’১৭-এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি।

শুধুমাত্র আবরার ফাহাদ ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডই নয়, এর পূর্ববর্তীতেও অসংখ্য শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিংয়ের দ্বারা কিংবা ছাত্র রাজনৈতিক দাপটের দ্বারা অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা রয়েছে, যা আমাদের বুয়েটের র‌্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার শাহরিয়ারকে স্ট্যাম্প দিয়ে রাতভর বেধড়ক মারধর করা হয়। ১৭ ব্যাচের মেহজাদ গালিবকে নগ্ন করে সোহরাওয়ার্দী হলের ছাদে তুলে স্ট্যাম্প দিয়ে সারারাত মারা হয়। ১৫ ব্যাচের সামিউত তৌসিফকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়। মারতে মারতে তিনটি স্ট্যাম্প ভেঙে ফেলা হয়। এই সামিউত তৌসিফ ছিল এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, তার চাচা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। তার লিগামেন্ট ছিড়ে পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। সালাম না দেওয়াতে সাখাওয়াত অভির হাত ভেঙে ফেলে আবরার ফাহাদের হত্যাকারী অমিত সাহা। সৌমিত্র লাহিড়ী থাপ্পর দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলে একজনের।’

ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েটের নানান সফলতা তুলে ধরে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বর্তমান বুয়েটে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ থাকায় নিজ নিজ প্রকৌশল ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণামুখী কাজে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি রাজনীতিবিহীন নিরাপদ ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য সারাদেশব্যাপী জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত এবং সমাদৃত হয়েছে। রাজনীতিমুক্ত বুয়েট ক্যাম্পাসের গত ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের এই সব সফলতা আমাদের জানান দেয়, আমরা আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ব্যতীতও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য যে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব গঠন এবং বিকাশ প্রয়োজন, তা করতে পারি, স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিরন্তর কাজ করে যেতে পারি।’

তারা আরো বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আজ অবধি প্রতিটি জাতীয় দিবস সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে আসছি। আমরা ছাত্ররা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের জাতীয় মূল্যবোধ ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে-প্রাণে ধারণ করি। দেশের গৌরবময় ইতিহাস, ত্যাগ-তিতিক্ষা আমরা অন্তরে লালন করি, ভবিষ্যতে পথচলায় অনুপ্রেরণা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয় মূল্যবোধ, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ আমাদের সকলের জন্যই প্রযোজ্য এবং একান্ত পালনীয়। আমরা সাংগঠনিক রাজনীতির ঊর্ধ্বে এসেই এই সচেতনতা রাখি। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কতিপয় ব্যক্তি বা গণমাধ্যমের তৎপরতায় ছাত্র রাজনীতিবিহীন বুয়েট ক্যাম্পাসকে জাতীয় চেতনার বিরোধী মতাদর্শের স্থান হিসেবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিষয়টিতে আমরা অত্যন্ত ব্যথিত।’

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের অভিভাবক। যারা নিজেদের মেধা ও শ্রমের সবটুকু দিয়ে বিজ্ঞানের অবাক করা দুনিয়ার একটা অংশের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে দেখতে চাই। আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না, আমরা শুধু দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, আপনি আমাদের পাশে দাঁড়ান। আপনি সব সময়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছেন, আমরা জানি এই দুর্দিনে আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।

আমাদের মাননীয় ভিসি মহোদয় এবং আমাদের সব শিক্ষকের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা জানি, তারা তাদের সন্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় সর্বদা সচেষ্ট আছেন এবং থাকবেন।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত