বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি

লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তি

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

তীব্র গরমে দেশজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। তবে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এতেও দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের পথ বেছে নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যার ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ। লোডশেডিংয়ের কারণে ঈদের বাজারেও বেচাকেনা ব্যাহত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ৩৬ থেকে ৩৯.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রবাহিত হয়েছে গতকাল শুক্রবার। আগামীতে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। তাদের ভাষ্যমতে, এলাকাভেদে চাহিদার তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ ভাগ বিদ্যুৎ কম মিলছে। বাধ্য হয়েই লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। সরবরাহ না বাড়লে সামনে ভোগান্তি আরও বাড়বে।

জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। গাইবান্ধা জেলায় কয়েকদিন ধরে দিন-রাতে বিদ্যুৎ না থাকার উৎপাত চলছে। তার ওপর রমজানে দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে কলকারখানার কাজ। ঈদের আগে এমন অবস্থায় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন মালিক-শ্রমিকরা। শ্রমিকরা জানান, ২ ঘণ্টা ৩ ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ আসে। দিনে-রাতে লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারেনি পল্লী বিদ্যুৎ ও নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির কর্মকর্তারা। তীব্র লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ ঝালকাঠি জেলাবাসীও। জেলা শহর, নলছিটি, রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলার পরিস্থিতি যেন ভয়াবহ। সারা দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন জীবন পার করতে হয়। একদিকে গরম অন্য দিনে রমজান সব মিলিয়ে হাঁসফাস অবস্থা। বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, দেশজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৫ হাজার ৪৫৭ মেগাওয়াট কিন্তু সেখানে বিদ্যুৎ উপাদনের ঘাটতি ছিল ২২৫ মেগাওয়াট। সেজন্য লোডশেডিং দিতে হয়েছে। একই অবস্থা চট্টগ্রামে। সেখানেও ১ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াটের চাহিদার স্থলে ১৭০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দিতে হয়েছে, খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৭১৭ মেগাওয়াটের চাহিদার স্থলে ১৩০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেওয়া হয়। রাজশাহীতে ১ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াটের চাহিদার থাকলেও ১৪০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। বিদ্যুতের জ্বালানি সরবরাহ ও উৎপাদানের ঘাটতি থাকায় প্রত্যেক বিভাগে লোডশেডিং চলছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কয়লা, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও সোলারসহ ৭টি উপাদানে ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সরকারের। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১২ হাজার ২২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে, দ্বিতীয় অবস্থায় রয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫ হাজার ৯৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েকদিন ধরে লোডশেডিং চলছে। দেড় শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াটের বেশি। তবে সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে তিন-সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে লোডশেডিং করে ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। সাগরে সামিট গ্রুপের ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল সংস্কার শেষে শিগগির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিকের পর বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়নো যাবে, সেজন্য আরও কিছু দিন সময় লাগতে পারে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সামিটের এলএনজি টার্মিনাল শিগগির আবার গ্যাস সরবরাহ শুরু করবে। এতে বিদ্যুতের ঘাটতি কমবে। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বেশি সময় চালাতে চাই না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। গ্রীষ্মের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। আশা করি, পরিস্থিতি ভালোই যাবে। সংকট হবে না। বিদ্যুৎ সংকটে জমিতে সেচ দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। বেকায়দায় আছেন মুরগির খামারিরা। রাজশাহী, রংপুর, টাঙ্গাইল, মির্জাপুর, মৌলভীবাজার ও কমলগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, নড়াইল, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও কুড়িগ্রামে দিনে কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

লোডশেডিংয়ের কারণে ঈদের আগমুহূর্তে কারখানা ঠিকভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না মালিকদের। শিল্পাঞ্চলে লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক উৎপাদক সময়মতো পণ্য চালান করতে পারছেন না। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে অনেক কারখানার মালিকদের উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য জেনারেটরের জন্য ডিজেল কিনতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) তথ্যমতে, এখন বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট, যা সামনে বেড়ে সাড়ে ১৭ হাজার হতে পারে। তবে গত দুই-তিন দিন সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। যদিও উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ না বাড়লে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার বিকালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ১৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ১২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, যা চাহিদার তুলনায় প্রায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কম। গত সপ্তাহেও একই অবস্থা ছিল। ঢাকার দুটি বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি ও ডেসকো) ছাড়া বাকি পাঁচটিই চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের কোম্পানি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ময়মনসিংহ জোনের বাসিন্দাদের কোনো কোনো দিন সাত ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এই জোনে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই। ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ (মুক্তাগাছা) এর মহাব্যবস্থাপক শহিদ উদ্দিন জানান, প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কম পাচ্ছেন। গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার আবুল বাশার আজাদ বলছেন, চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন বলেন, রাজশাহী শহরে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৬৫ মেগাওয়াট পাচ্ছেন।

পিডিবির সদস্য (জেনারেশন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ ঘাটতির পেছনে গ্যাস সংকট। দৈনিক এক হাজার ২০০ এমএমসিএফডি (মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের চাহিদা থাকলেও প্রায় ৯৯০ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা হয়। তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন করার জন্য নয়। গ্যাস সংকটের কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে কিছু কিছু ২৪ ঘণ্টা চালানো হচ্ছে। সামিটের এলএনজি টার্মিনালের সংস্কার চলছে। সংস্কার কাজ শেষ হলে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিকের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে।