সর্বত্র ঈদুল ফিতরের আমেজ

এবারে স্বস্তির ঈদযাত্রা

প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সর্বত্র ঈদুল ফিতরের আমেজ। আর এই উৎসবের আমেজ পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে নাড়ির টানে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করছেন মানুষ। তবে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের এই যুগে সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের এবারের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কম হবে। কারণ, ঈদের ছুটিতে আগেভাগেই মানুষ গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।

গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুল, কল্যাণপুর, গাবতলী, মহাখালী ও আব্দুল্লাপুর বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীর চাপ দেখা গেছে। বাসস্ট্যাান্ডের পাশাপাশি রেলস্টেশন ও লঞ্চঘাটে যাত্রীর চাপ ছিল। ব্যক্তিগত গাড়িতেও অনেকেই ঢাকা ছাড়ছে। বিভিন্ন সেতুর টোল প্লাজায়ও ছিল গাড়ির জট। তবে মহাসড়কগুলোয় ট্যাফিক ব্যবস্থাপনায় বাড়তি নজর রেখেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এতে সড়কে বাস দাঁড়িয়ে রেখে যাত্রী ওঠানোর সুযোগ নেই। বাস, ট্রেন ও লঞ্চে এখনো ভোগান্তি ছাড়াই নির্বিঘ্নে ঈদ যাত্রা চলছে। এর মধ্যেই গতকাল উত্তরাঞ্চলের ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন ও সুন্দর করতে সিরাজগঞ্জের পাঁচিলা ওভারপাস, মুলিবাড়ী ওভারপাস, দাদপুর ওভারপাস এবং দাতিয়া সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ওই তিনটি ওভারপাস এবং সেতুর ওপর দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন যাতায়াত করতে শুরু করেছে।

আব্দুল্লাপুর শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে সরকারি চাকরিজীবী কাওসার উদ্দিন তার পরিবারের সদস্যদের আগেভাগে গ্রামের বাড়ি রংপুরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সড়কের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সময়মতো বাস পেয়েছি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ছে। অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে দিনে-রাতে মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মেঘনা সেতু থেকে কুমিল্লার দাউদকান্দি মেঘনা-গোমতী সেতু এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা এলাকায় যানজট লাগতে পারে, সেটি চিহ্নিত করে বাড়তি হাইওয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যানবাহনের পাশাপাশি যাত্রীবাহী বাস ও মোটরসাইকেলের চাপ বেড়েছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েসহ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তের পদ্মা সেতু টোল প্লাজা এলাকায়।

পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজায় সাতটি টোল বুথে প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একটি করে যানবাহনে টোল আদায় করা হচ্ছে। তবে মোটরসাইকেলের উপচে পড়া ভিড় থাকায় আলাদা দুটি লেন তৈরি করে টোল আদায় করা হচ্ছে। ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২-এর (এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক) আওতায় নির্মিত পাঁচটি উড়ালসড়ক যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বাসের পাশাপাশি এবার ট্রেন যাত্রায় স্বস্তি ফেরাতে ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালু করা হয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মোটামুটি সব ট্রেনই সময়মতো ছেড়েছে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার চালু হয়েছে ঈদ যাত্রার বিশেষ ট্রেন। প্রায় সব ট্রেনেই ভিড় থাকলেও স্বস্তি প্রকাশ করেছে যাত্রীরা। টিকিট ছাড়া কোনো যাত্রী প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। স্টেশনের প্রবেশমুখেই শুধু যেসব গাড়িতে ট্রেনের যাত্রী আছে, সেগুলোকেই স্টেশন এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। এরপর যাত্রীরা নেমে প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করছে। তারপর দ্বিতীয় ধাপে টিকিট চেক করা হচ্ছে। শেষ দফায় প্ল্যাটফরমে প্রবেশের ঠিক আগে আরো একদফা জাতীয় পরিচয়পত্র ও টিকিট চেক করে দেখা হচ্ছে। লালমনি এক্সেপ্রেসের ট্রেনের যাত্রী মারুফ সরদার বলেন, সচিবালয়ে কর্মরত থাকার কারণে গ্রামে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় খুব বেশি যাওয়া হয় না। কারণ পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। কিন্তু এবার সরকারি ছুটিসহ নিজেও দুই দিনের ছুটি নিয়ে আগেভাগেই গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। সেজন্য আগেই লালমনি এক্সেপ্রেস ট্রেনের টিকিট অনলাইনে কেটে রেখেছিলাম। নির্ধারিত সময়ে ট্রেনে উঠতে পেরেছি। ট্রেনের মধ্যেও বাড়তি যাত্রী ছিল না। রেলের ঢাকা বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম বলেন, ঈদে যাত্রীদের চাপ সামার দিতে ৬৭টি ট্রেন ঢাকা ছাড়বে। এর মধ্যে ৪২টি আন্ত নগর, বাকিগুলো কমিউটার ও মেইল ট্রেন। স্টেশনের ভিড় কমাতে দুটি আন্ত নগর ট্রেন চিলাহাটি এক্সপ্রেস ও নীলসাগর এক্সপ্রেস বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ছাড়বে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর লঞ্চের যাত্রী কমেছে। তবে ঈদের সময়ে শেষ বেলায় যাত্রী পাচ্ছে লঞ্চ মালিকরা। নৌপথে ঈদ যাত্রীদের চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে লঞ্চের কেবিনের চাহিদা বেশি। ডেকে তুলনামূলক যাত্রী কম। যাত্রী বাড়তে থাকায় লঞ্চের সংখ্যাও বাড়িয়েছেন লঞ্চ মালিকরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবার মহাসড়কগুলোর অবস্থা আগের তুলনায় ভালো। রাস্তার বেহাল অবস্থার কারণে আগের মতো ঈদযাত্রায় যানজটের ভোগান্তি কমবে। বর্তমানে দেশের সড়ক পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বেশিরভাগ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। আন্তঃজেলা সংযোগ সড়কগুলোর অবস্থা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। সারা দেশে অসংখ্য বাইপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ হয়েছে। মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ মোড় সংস্কারের পর সোজা হয়েছে। অধিক যানবাহন চলাচলের মহাসড়কের মাঝখানে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী ডিভাইডার তৈরি করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রয়োজনীয় গতিনিয়ন্ত্রক সাইনবোর্ড ব্যবহার করেছে। এসব কারণে মহাসড়কগুলোয় যানবাহনের গতি বেড়েছে মানুষের ভোগান্তি কমেছে। সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশ সোচ্চার রয়েছে।

ঈদযাত্রায় মহাসড়কে ভোগান্তি কমানোর বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেছেন, দেশের বৃহত্তম ময়মনসিংহ ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের ৩২টি জেলার ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রা নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও স্বস্তিদায়ক করা হবে। সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করা হয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের জেলার কালিয়াকৈররে চন্দ্রা, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের শ্রীপুর মাওনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানজট নিরসন ও নিরাপদ যাত্রার জন্য সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। মহাসড়ক কিংবা সড়কের পাশে অবস্থিত অবৈধ দখল উচ্ছেদ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা হয়েছে। সড়কে অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।

এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঈদযাত্রা নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক করার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। তিনি এসব বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন। যেখানে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সচেতন, সেখানে আমরা ঘরে বসে থাকতে পারি না। মহাসড়ক এবং সড়কের অবস্থাও অনেক উন্নত হয়েছে। ব্যবস্থাপনায় অনেক আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মাহফুজুর রহমান, ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে মানুষের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি, ড্রোন, বডি ওন ক্যামেরা ব্যবহার করাসহ বিভিন্ন রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা-বরগুনা নৌপথে চলাচলকারী এমভি পূবালী-১ লঞ্চের যাত্রী কাজল সরকার বলেন, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। বাসে যাতায়াত করলে সময় কম লাগে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ বাসে বসে থাকতে অস্বস্তি লাগে। তাই লঞ্চে বাড়ি যাচ্ছি। এবার লঞ্চে ভোগান্তি কম, সহজেই কেবিন পাওয়া গেছে। বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, নৌপথের যাত্রীদের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা যাবে না। লঞ্চের ফিটনেস সার্ভে ছাড়া লঞ্চ টার্মিনাল ছেড়ে যেতে পারবে না। এছাড়া সনদধারী নির্ধারিত মাস্টার ও চালক দিয়ে লঞ্চ চালাবে।