প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক

কিশোর গ্যাং মোকাবিলায় বিশেষ নির্দেশনা

সংশোধনাগার বাড়াতে হবে

প্রকাশ : ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সারা দেশে কিশোর গ্যাং মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কিশোর গ্যাং মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবাইকে ইনভলব হতে বলেছেন। প্রথাগতভাবে যেভাবে অন্য অপরাধীদের হ্যান্ডেল করি তাদের (কিশোর গ্যাং) ক্ষেত্রে একটু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি দিতে বলেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন। তারা একটি অপরাধে জড়িত হলে তাদের যেন দীর্ঘমেয়াদে অপরাধী বানিয়ে না ফেলি। তাদের সংশোধনের জন্য যেন সুযোগ রাখা হয়। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের নিয়োজিত করার যেন সুযোগ রাখা হয়, সে বিষয়ে বলেছেন। জেলখানায় যখন রাখা হয় তখন তাদের যাতে অন্য আসামিদের সঙ্গে রাখা না হয় সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রকল্প নেওয়ার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এরই মধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

মাহবুব হোসেন সচিব বলেন, দেশে এখন তিনটি সংশোধনাগার আছে, এর সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আরো সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে বলেছেন, যাতে করে তারা সংশোধন হতে পারে। সমাজে, রাষ্ট্রে তারা যেন তাদের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারে, সেভাবে যেন আমরা তাদের সংশোধন করি। কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে বলেছেন। কিশোর অপরাধীদের যখন ব্যবস্থাপনা করা হয় তখন যেন অবশ্যই মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সিলিংয়ের বড় ভূমিকা পালন করেন। অভিভাবক, শিক্ষক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরো বলেন, আইন স্বাভাবিক গতিতে চলবে। এদেরকে যখন হ্যান্ডেল করব তখন তাকে যেন তাকে আরো অপরাধী না বানাই। তাকে যেন সংশোধন হওয়ার পরিবেশ দেওয়া হয়। জেলে থাকলেও যেন ভালো নাগরিক হয়ে বের হয়ে আসতে পারে। সংশোধনের সুযোগটা যাতে তারা পায়। কিশোর অপরাধীদের হ্যান্ডেল করার সময় মনে রাখতে হবে তারা ভবিষ্যতের নাগরিক। অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যাতে তাদের যেন না রাখি। বিশেষ কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখার কথাও বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশালসহ দেশের বিভিন? এলাকায় কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পারিবারিক সংকট, মাদক, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনাখুনিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। তাদের হাতে ঘটছে হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কিশোর গ্যাং মোকাবিলায় সামাজিকভাবে ক্যাম্পাইন দরকার। সুস্থ বিনোদনের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যদিয়ে সন্তানদের লালন-পালন করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষকদের বড় দায়িত্বটি পালন করতে হবে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব স্থানে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্লাসের পাশাপাশি কাউন্সিলিং আওয়ারের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে যখন কোনো শিক্ষার্থী ভুল পথে ধাবিত হবে তখনই তাদের আলাদা করে নিয়ে কাউন্সিলিং করে একটা সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

২০২২ সালের শেষের দিকে ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে পুলিশ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন? অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন। বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট।

নানা অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদকসহ নানা অপরাধে কিশোররা খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনার পর কিশোর গ্যাং সদস্যদের তৎপরতা রোধে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে নতুন বছরের শুরুতে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে একাধিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এরই মধ্যে ঢাকার পাড়ামহল্লার কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তালিকা ধরে র‌্যাবও অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামতে, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পর্যায়ক্রমে আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন?। তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে।

তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তারা অর্থ সংস্থানের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো ‘বড় ভাই’র সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে। সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়।