এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক মুক্ত ১৯ এপ্রিল পৌঁছবে দুবাই বন্দরে

ছোট বিমান থেকে ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয় সাগরে

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

দীর্ঘ এক মাস পর সোমালিয়ায় জলদস্যুদের কাছে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা মুক্তি পেয়েছেন। বাংলাদেশ সময় গত রোববার ভোর রাত ৩টার পর জাহাজের ২৩ নাবিক মুক্তি পান। এতে নাবিকদের পরিবার, জাহাজ মালিক, বাংলাদেশের মেরিটাইম খাতে স্বস্তি ফিরে এসেছে। মুক্ত জাহাজটি এখন দুবাই বন্দরের পথে রয়েছে। ১৯ থেকে ২০ এপ্রিল সেখানে পৌঁছানোর পর নাবিকরা দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে। মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজটি মুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে মালিক পক্ষ। তবে কত টাকা মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে, তা বলেনি।

জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম নাবিকদের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, জাহাজটিতে থাকা ২৩ নাবিক মুক্তির পর কাছের বন্দরের উদ্দেশে জাহাজটি নিয়ে রওনা দিয়েছেন। এর আগে জিম্মি জাহাজে ঈদ জামাত আদায় করেছিলেন নাবিকরা। ঈদের নামাজের পর তারা একসঙ্গে ছবিও তোলেন। এ খবরে উদ্বিগ্ন পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিয়েছিল।

সংবাদ সম্মেলনে যা বলল মালিক পক্ষ : আগামী ১৯ থেকে ২০ এপ্রিল দুবাই পৌঁছাবে সোমালিয়ায় ৩১ দিন জলদস্যুর কবলে থাকা এমভি আবদুল্লাহ। এরপর নাবিকদের দুইটি অপশন থাকছে। প্রথমত তারা ফ্লাইটে, দ্বিতীয়ত ওই জাহাজেই দেশে ফিরতে পারবেন। গত রোববার দুপুরে বারিক বিল্ডিং মোড়ের কেএসআরএম ভবনে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমডি শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তিনি বলেন, জাহান মণি জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়ার ১৪ বছর পর দুর্ভাগ্যবশত একই ঘটনা ঘটল। গত ১২ মার্চ এ জাহাজ আক্রমণের শিকার হয়েছিল অস্ত্রের মুখে। ৩১ দিন পর ফাইনালি জলদস্যুরা জাহাজটি ছেড়ে যায়। সাধারণত দস্যুরা মালিকপক্ষকে টার্গেট করে বেশি স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তাই আমরা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে আলোচনা শুরু করি।

শাহরিয়ার জাহান রাহাত আরো বলেন, আমাদের জাহাজ হাইরিস্ক এরিয়ার বাইরে ছিল। ২০০ নটিক্যাল মাইল রিস্কি। আমরা ৬০০ নাটিক্যাল মাইলে ছিলাম। তাই আর্ম গার্ড নিইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ধন্যবাদ জানাতে চাই। বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ফোর্সফুলি জাহাজটি উদ্ধারে যেতে চেয়েছিল। আমাদের সরকার কুইক রেসপন্স করেছে। সাংবাদিকরা সহযোগিতা করেছেন। ১৯ ও ২০ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাবে জাহাজটি আশাকরি। এরপর নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেএসআরএম’র সিইও মেহেরুল করিম বলেন, জাহান মণির সময় আমাদের জ্ঞানের অভাব ছিল। তখন উদ্ধারে সময় বেশি লেগেছিল। এবার জাহাজ দখলে নেওয়ার পর আমরা জাহাজের লোকেশন ট্রেক করতে থাকি। যোগাযোগ শুরুর পর প্রতিদিনই কথা হচ্ছিল। নাবিকরা কেমন আছে, কত তাড়াতাড়ি দস্যুরা জাহাজ ছেড়ে যাবে ইত্যাদি কথা হতো। দুই দিন আগে আমাদের দাবি ছিল, তাই প্রত্যেক নাবিকের ভিডিও নিয়েছি। মুক্তিপণের প্রতিটি কাজ আইনগতভাবে করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে করা হয়েছে। কত ডলার সে বিষয়টি আমরা নানা কারণে বলতে পারছি না। ইউএসএ, ইউকে, সোমালিয়া, কেনিয়ার নিয়ম মানতে হয়েছে। গত রোববার ভোর ৩টায় কথা হয় ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। জলদস্যুরা ৬৫ জন ছিল। বোটে করে তারা চলে যায়। নাবিকদের অপশন আছে ফ্লাইটে আসা কিংবা জাহাজে আসা। জাহান মণি ১০০ দিন ছিল। নাবিকদের ভিসা সমস্যা ছিল। আবদুল্লাহ জাহাজটি দুবাই থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসব।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কেএসআএমের ডিএমডি করিম উদ্দিন, সরওয়ার জাহান রোকন, গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।

৯টি বোটে পালিয়ে যায় ৬৫ জলদস্যু : ভারত মহাসাগরে গত ১২ মার্চ জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজে উঠে প্রথমে নাবিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এরপর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় নিয়ে যেতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে সুবিধাজনক স্থানে জাহাজটিকে নোঙর করায় দস্যুরা। এরপর মুক্তিপণের বিষয়ে দেনদরবার শুরু হয়।

দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমঝোতা করতে কাজ শুরু করে। যদিও মাঝখানে দস্যুমুক্ত করতে জাহাজে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিল বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী। তবে নাবিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকায় এতে রাজি ছিল না জাহাজের মালিক পক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকার। তারা শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে জাহাজকে মুক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।

জাহাজ উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমালিয়ান দস্যুদের বেশিরভাগই ইংরেজি ভাষা জানে না। ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে দস্যুদের একজন কমান্ডার ছিল, তার সহকারী মোটামুটি ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ করতে পারতেন। তার মাধ্যমে যোগাযোগটা শুরু হয়। এরপর নাবিকদের সার্বিক বিষয়ে তদারকি করত মালিক পক্ষ। শুরুতে দস্যুরা নাবিকদের বিষয়ে একটু কড়াকড়ি করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দস্যুরা স্বাভাবিক আচরণ করে। দর কষাকষি শেষে ঈদের আগে দস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণের কত হবে সেটি চূড়ান্ত হয়।

কিন্তু এসব টাকা কীভাবে পৌঁছানো হবে, সেটি নিয়ে বিপত্তি বাধে। এক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা কাজ লাগায় জাহাজের মালিক পক্ষ। সিদ্ধান্ত হয় বিমানে পাঠানো হবে মুক্তিপণ। অপেক্ষাকৃত ছোট যেসব বিমান মোটামুটি নিচে চলাচল করতে পারে এ রকম একটি বিমানে করে মুক্তিপণের ডলার নিয়ে এমভি আবদুল্লাহর কাছে পৌঁছে যায় বিমান। বাংলাদেশ সময় শনিবার (১৩ এপ্রিল) বিকালে বিমান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন। ওই সময় জাহাজের উপরে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় নাবিকদের। এরপর জাহাজ থেকে ডলারভর্তি তিনটি ব্যাগ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সেগুলো স্পিডবোট দিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে জাহাজে উঠে দস্যুরা। এ সময় দাবি অনুযায়ী ডলার আছে কি না সেটিও নিশ্চিত হয়ে নেয় দস্যুরা।

জিম্মি জাহাজের মালিক পক্ষ কেএসআরমের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, আমরা জানতাম নাবিকরা ভালো আছেন। তারপরও সর্বশেষ গত দুই দিন আগে আমাদের শেষ রিকোয়ারমেন্টট ছিল নাবিকরা কেমন আছেন সেটা জানা। এ জন্য প্রত্যেক নাবিকের স্বতন্ত্র ভিডিও আমরা নিয়েছি, সেটি তারা আমাকে পাঠিয়েছে। এরপর আমরা ওদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করি। সবকিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে আমরা আমেরিকার নিয়ম মেনেছি, কোনো ক্ষেত্রে ইউকে, আবার কোনো ক্ষেত্রে সোমালিয়ার নিয়ম মেনেছি।

মুক্তিপণের টাকা দেয়া হয় ছোট বিমানে করে : একটি ছোট বিমানে করে মুক্তিপণের ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলা হয় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের আশপাশে। তিন দফায় ডলার ভর্তি তিনটি ব্যাগ ফেলা হয়। ডলার ভর্তি ব্যাগ নিয়ে জলদস্যুরা আবার উঠে পড়ে জাহাজে। সেখানে গোনা শুরু হয় কথা মতো ডলার দিয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে। এরপর দেখা হয় ডলারগুলো জাল কি না। এর কয়েক ঘণ্টা পরই জাহাজ থেকে নেমে পড়ে জলদস্যুরা। মুক্ত হয় এমভি আবদুল্লাহ।

গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।