পাহাড় ঘিরে যৌথবাহিনীর চিরুনি অভিযান চলছেই

* কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ক, উপদেষ্টাসহ ৬৩ জন কারাগারে * জনশূন্য বমপাড়া * চার দিনের সাংগ্রাই উৎসবের সমাপ্তি আজ

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, বান্দরবান থেকে

বান্দরবানে ব্যাংকে হামলাসহ বেশ কিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে সশস্ত্রগোষ্ঠী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে নির্মূল পাহাড়ে চলছে যৌথবাহিনীর চিরুনি অভিযান। গতকাল সোমবার পর্যন্ত কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ক ও উপদেষ্টাসহ ৬৩ জনকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে প্রেরণ করেন আদালত। যৌথ অভিযানে ভীত বম সম্প্রদায়ের লোকজন পাড়া ছেড়েছেন। বেশিরভাগ বমপাড়া এখন জনশূন্য।

চলতি মাসের শুরুর দিকে ২ এপ্রিল রাতে এবং ৩ এপ্রিল দুপুরে বান্দরবানের রুমায় সোনালী ব্যাংক লুট এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। এর পরের দিন (৪ এপ্রিল) পার্শ্ববর্তী থানচি উপজেলার কৃষি ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় দিনে-দুপুরে চাঁদের গাড়িতে করে এসে প্রকাশ্যে হামলা চালায় কেএনএফের শতাধিক অস্ত্রধারী। এরপর থেকে কেএনএফের সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করতে চিরুনি অভিযানে শুরু যৌথবাহিনী। অভিযানে গ্রেপ্তার হয় কেএনএফের প্রধান সমন্বয়ক ও উপদেষ্টাসহ ৬৩ জন। কেএনএফ নির্মূল করতে বান্দরবানে মোতায়েন করা হয় সেনা, বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর বাড়তি জনবল। এছাড়া নামানো হয়েছে সাঁজোয়া বিশেষ যান। বর্তমানে পাহাড়ে কেএনএফের অবস্থান জানতে ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন। অভিযানের আতঙ্কে বিভিন্ন পাড়ার বম সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো পাড়া ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ফলে এরই মধ্যে বেশিরভাগ বম পাড়াগুলো জনশূন্য হয়ে পড়েছে।

একাধিক বম পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুকি চিনের সদস্যদের ধরতে অভিযানে অনেক নিরীহ মানুষও ধরা পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাই এসব অভিযান থেকে বাঁচতে অনেকেই স্বজনদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। এতে বম জনগোষ্ঠীর লোক অধ্যুষিত পাড়াগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। কয়েকটি বমপাড়া ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

এদিকে ঈদের পরদিন থেকে বান্দরবানে কিছু পর্যটক দেখা গেলেও তার পরিমাণ হাতে গোনা। হোটেল মোটেলে রুম বাতিল হয়েছে বেশিরভাগ। পর্যটক না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ব্যবসায়ী। বান্দরবান সদরের আবাসিক হোটেল হিলভিউ হোটেলের ম্যানেজার পারভেজ জানান, ঈদ উপলক্ষ্যে প্রচুর পর্যটক বান্দরবানে বুকিং পেয়েছিলাম। কিন্তু কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় এবারে হোটেল বুকিং নেই, যারা আসছে তারা ও আশপাশের জেলায় চলে যাচ্ছে। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রুমার বগালেক, থানচির নাফাখুম ও রোয়াংছড়ির দেবতাখুমসহ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র ছাড়া বান্দরবান সদরের নীলাচল, মেঘলা, শৈপ্রপাত, চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি, লামার মিরিঞ্জা, আলীকদমের আলীর সুরঙ্গ, নাইক্ষ্যংছড়ির উপবনসহ সবকটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে নিরাপদ রয়েছে। এসব স্থানে পর্যটকরা অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারবেন বলেও দাবি করছেন তারা। ঢাকা থেকে আসা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটের) ছাত্রী সুবর্ণ বিটি বলেন, প্রথমবার বান্দরবানে এসেছি। আঁকাবাঁকা রাস্তা, সবুজ পাহাড় অন্যরকম অনুভূতি। এক কথায় অসাধারণ বলে জানান তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা তানজিলা রশিদ বলেন, ঈদের ছুটিতে আনন্দময় মুহূর্ত কাটানোর জন্য পর্যটন কেন্দ্র নীলাচল ঘুরতে এসেছি। তবে আগের তুলনায় পর্যটক কম। হয়তো রুমা-থানচি ঘটনার প্রেক্ষাপটের কারণে।

হিলভিউ হোটেলের ফ্রন্টডেক্স ম্যানেজার আবদুর রহিম জানান, এ মৌসুমে আশানুরূপ আগাম বুকিং পেয়েছিলাম। তিন দিনে গড়ে প্রায় দেড় শতাধিক রুমের আগাম বুকিং বাতিল করেছে ভ্রমণ প্রত্যাশীরা। বর্তমানে ১০ শতাংশ কক্ষও বুকিং নেই তাদের। হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি অমল কান্তি দাশ বলেন, ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে হোটেলের সব রকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। ঈদের আগে প্রায় হোটেলে অগ্রিম বুকিং হয়েছিল। রুমা ও থানচির ঘটনায় অধিকাংশ বুকিং বাতিল করেছে। বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ পরিদর্শক স্বপন কুমার আইচ জানান, রুমা-থানচি ছাড়া বাকি স্পটগুলোর পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। দূরের জেলাগুলো থেকে পর্যটকের উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলে আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ব্যাপক দর্শনার্থীদের ভিড় রয়েছে নীলাচল ও মেঘলা পর্যটন স্পটে। আগতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশের পক্ষ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, বান্দরবানের সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে বড় ধরনের আতঙ্কের কিছুই নেই। দীর্ঘ ছুটিতে বান্দরবানে পর্যটকরা অনায়াসে আসতে পারবেন এবং ভ্রমণ করতে পারবে। রুমা এবং থানচি ছাড়া বান্দরবানের অন্যান্য উপজেলাগুলোতে অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে এবং সেখানে ভ্রমণ করতে আমরা পর্যটকদের উৎসাহিত করছি। তিনি বলেন, বান্দরবানে মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবটিও সকলে উপভোগ করতে পারবেন অনায়াসে। এখানে কুকি চিন সন্ত্রাসীদের কোনো প্রভাব নাই। তারপরও আমরা বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছি। এদিকে কেএনএফের সন্ত্রাসীদের ধরতে নতুন করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ৯০ শতাংশ সদস্য বান্দরবানের যৌথ অভিযানে অংশ নিয়েছেন। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আলী আহমদ খান সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বর্ষবরণকে ঘিরে এখন বর্ণিল সাজে পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। পাহাড়ে তিন সম্প্রদায়ের বড় সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই। জেলায় বসবাসরত ১২টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের প্রায় প্রতিটি ঘরে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ। এর মধ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই উৎসব শুরু হয়েছে। গত শনিবার (১৩ এপ্রিল) সকালে বান্দরবান শহরের ঐহিত্যবাহী রাজারমাঠ এলাকা থেকে একটি বর্ণাঢ্য মঙ্গলশোভাযাত্রা বের করা হয়। এতে পাহাড়ি সম্প্রদায়গুলোর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে শোভাযাত্রায় অংশ নেন মারমা, চাকমা, ম্রো, ত্রিপুরাসহ ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষসহ বাঙালিরাও। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন সাবেক পার্বত্য মন্ত্রী ও ৩০০নং আসনের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসি। এ সময় তিনি সবাইকে বাংলা নববর্ষ ও সাংগ্রাই উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বান্দরবানে সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব সব কিছুই আছে। তাই ‘পরিবেশ’র প্রশ্ন তোলার কোনো প্রয়োজন নেই।

শান্তি সম্প্রীতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বান্দরবানবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সু-নেতৃত্বের কারণেই আজকে পার্বত্য অঞ্চলে সুখ, সমৃদ্ধি, শান্তি বজায় রয়েছে। আগামীতে সকল দলমতের মানুষ শান্তিতে এগিয়ে যাবে। পরে বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে গিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বয়স্ক পূজার মধ্যদিয়ে সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্মান জানানো হয়। গত রোববার (১৪ এপ্রিল) বিকালে সাঙ্গু নদীর তীরে বৌদ্ধমূর্তি স্নান এবং সোম ও মঙ্গলবার স্থানীয় রাজার মাঠে সাংগ্রাইয়ের অন্যতম আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা উৎসবে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটবে। পারস্পরিক মৈত্রীর বন্ধন অটুট রাখা এবং পুরাতন বছরের গ্লানি মুছে ফেলাই হচ্ছে এ জলকেলির মূল উদ্দেশ্য। নানা আয়োজনে চলবে মারমা সম্প্রদায়ের এই সাংগ্রাই উৎসব উদযাপন। আজ সন্ধ্যায় বিহারে বিহারে সমবেত প্রার্থনার মধ্যদিয়ে সমাপ্তি ঘটবে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী চার দিনের এই সাংগ্রাই উৎসবের।