নিষিদ্ধ যানবাহনে যাত্রী বহন

সড়ক হয়ে উঠছে মৃত্যুকূপ

* ফরিদপুরে একই পরিবারের চারজনসহ নিহত ১৪ * দায় এড়াতে পারে না কর্তৃপক্ষ : জাতীয় কমিটি

প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ঈদযাত্রায় প্রতি বছরের মতো এবারো বাস, ট্রেন ও লঞ্চের টিকিট সংকট থাকায় পিকআপ ও ট্রাকে চড়ে গন্তব্যস্থলে ফিরছেন যাত্রীরা। তবে মহাসড়কে পিকআপ ও ট্রাকে যাত্রী বহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু পিকআপ ও ট্রাক চালকরা সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বাড়তি আয়ের নেশায় যাত্রী টানছে। এতে মহাসড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা, মরছে মানুষ। জানা গেছে, গতকাল ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মাগুরাগামী ইউনিক পরিবহনের সঙ্গে ঢাকাগামী একটি যাত্রী বহনকারী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ফরিদপুরের কানাইপুরে। এতে ঘটনাস্থলে ছয় নারী ও দুই শিশুসহ ১১ জন নিহত হয়। হাসপাতালে আনার পরে আরো তিনজনসহ মোট ১৪ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৩ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- আলফাডাঙ্গা উপজেলার হিদাডাঙ্গা গ্রামের সৈয়দ নেওয়াজ আলীর মেয়ে জাহিনুর বেগম (৬০), আলেক সরদারের স্ত্রী শুকুরুন নেছা (৭০), মৃত ইব্রাহিম খাঁর স্ত্রী সুর্য বেগম (৫০), কুসিমদি গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে পিকআপচালক মো. নজরুল ইসলাম (৩৫), বেজিডাঙ্গা গ্রামের নান্নু মোল্লার স্ত্রী জাহানারা বেগম (৪৫), মিল্টন শেখের স্ত্রী সোনিয়া বেগম (২৮), মেয়ে নুরানি (২), চর বাকাইল গ্রামের মৃত রশিদ খানের ছেলে তবিবুর খান(৫৫), বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নের ছত্রকান্দা গ্রামের তারা মোল্লার ছেলে রাকিব হোসেন মোল্লা মিলন (৪২), তার স্ত্রী শামিমা ইসলাম সুমি (২৫), দুই ছেলে আলভি রুহান মোল্লা (৭), আবু ছিনান ওরফে হাবিব মোল্লা (৪) ও প্রতিবেশী মৃত আব্দুল ওহাবের স্ত্রী মর্জিনা বেগম (৬৫)। এ খবর লেখা পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আর আহতরা ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এ ঘটনায় শোকবার্তা প্রকাশ করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের খোঁজ খবর নিয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন মন্ত্রী।

হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডাক্তার দীপক কুমার বিশ্বাস জানান, হাসপাতাল আনার পরে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে, গুরুতর আহত অবস্থায় একজনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে, অন্য পাঁচজন বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে তারা আশঙ্কামুক্ত বলেও দাবি করেন তিনি। ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ মোর্শেদ আলম জানান, দুর্ঘটনার পর পরই খবর পেয়ে পুলিশের উপস্থিত হয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। সড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়। তিনি আরো জানান, দ্রুতগতির কারণেই এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

অন্যদিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল আহসান তালুকদার জানান, ঘটনা হতাহতদের খোঁজখবর নিয়েছে জেলা প্রশাসন। আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতে কাজ করা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেককে তাৎক্ষণিক ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া সরকারঘোষিত ৫ লাখ টাকা প্রতি পরিবারকে দেয়া হবে। করিমপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা এবং আহতদের ৩ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মরিয়ম বেগম জানান, ঘটনাস্থলে আসার পর বাসটির একটি চাকা রাস্তার গর্তে পড়ে যায়। গাড়িটি আড়াআড়ি সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় পিকআপটি বাসটির মাঝামাঝিতে এসে আঘাত করলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আরেক বাসিন্দা জানান, রাস্তা উঁচুনিচু হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটে। লাল মিয়া নামে অন্যজন জানান, ফরেস্ট অফিস থেকে তেঁতুলতলা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ। রাস্তা দূর থেকে মসৃণ মনে হয়, কিন্তু কাছে এলে উঁচুনিচু ও ভাঙাচোরা বোঝা যায়। গত এক বছরে প্রায় ১৫০-এর বেশি ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।

তবে কারণগুলো অস্বীকার করে সড়ক ও জনপদ বিভাগের (গোপালগঞ্জ জোন) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সাদেকুল ইসলাম বলেন, অভিযোগগুলো সঠিক নয়। সড়কের অবস্থা ভালো আছে। তবে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর বিস্তারিত তথ্য জানানো সম্ভব হবে।

মার্চে ৬২৪ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫৫০ : গত মার্চ মাসে সারাদেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৬৮৪ জন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের গত ৯ এপ্রিল স্বাক্ষরিত সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। বিআরটিএর বিভাগীয় অফিসের মাধ্যমে সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১০৫টি দুর্ঘটনায় ৯৮ জন নিহত এবং ৯০ জন আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ১২২টি দুর্ঘটনায় ১০৪ জন নিহত এবং ১৫০ জন আহত হয়েছেন; রাজশাহী বিভাগে ১১৯টি দুর্ঘটনায় ১০৩ জন নিহত এবং ৭৮ জন আহত হয়েছেন; খুলনা বিভাগে ৮৪টি দুর্ঘটনায় ৭১ জন নিহত এবং ৮৯ জন আহত হয়েছেন; বরিশাল বিভাগে ৩২টি দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত এবং ৮৪ জন আহত হয়েছেন; সিলেট বিভাগে ৩৭টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত এবং ৭৩ জন আহত হয়েছেন; রংপুর বিভাগে ৬৭টি দুর্ঘটনায় ৬০ জন নিহত এবং ৬৫ জন আহত হয়েছেন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮টি দুর্ঘটনায় ৫১ জন নিহত এবং ৫৫ জন আহত হয়েছেন। মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত মোটরযানের মধ্যে মোটরকার/জিপ ৩০টি, বাস/মিনিবাস ৯০টি, ট্রাক/কাভার্ডভ্যান ২০৪টি, পিকআপ ৪০টি, মাইক্রোবাস ১৯টি, অ্যাম্বুলেন্স ৪টি, মোটরসাইকেল ২০৪টি, ভ্যান ২৯টি, ট্রাক্টর ৩০টি, ইজিবাইক ৪১টি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৪৪টি, অটোরিকশা ৭২টি ও অন্যান্য যান ১৪৮টিসহ সর্বমোট ৯৫৫টি যানবাহন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মোটরকার/জিপ দুর্ঘটনায় ১২ জন, বাস/মিনিবাস দুর্ঘটনায় ৪৬ জন, ট্রাক/কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনায় ৮৫ জন, পিকআপ দুর্ঘটনায় ১৬ জন, মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ১৩ জন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬১ জন, ভ্যান দুর্ঘটনায় ১৫ জন, ট্রাক্টর দুর্ঘটনায় ১৬ জন, ইজিবাইক দুর্ঘটনায় ২২ জন, ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় ২০ জন, অটোরিকশা দুর্ঘটনায় ৫৯ জন ও অন্যান্য যান দুর্ঘটনায় ৮৪ জনসহ সর্বমোট ৫৫০ জন নিহত হয়।

ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনার দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না : ফরিদপুরের কানাইপুরে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি। গতকাল সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ শহীদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে এক বিবৃতিতে এ শোক প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানসহ পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন যাত্রী নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে ঢাকায় আসছিল। নিহত সবাই পিকআপ ভ্যানের যাত্রী ছিলেন। সুতরাং, পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির দায় এড়াতে পারে না বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা নিহত পরিবারগুলোকে উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহতদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ ও চিকিৎসা শেষে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।

এদিকে গতকাল ময়মনসিংহ-শেরপুর মহাসড়কে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ২৫ যাত্রী। তারাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়াজেদ আলী খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত বাস দুটি সড়কের পাশে জমিতে উল্টে পড়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে উদ্ধার কাজ করে। এ ঘটনায় দুই যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

প্রসঙ্গত, গত ১৯ মার্চে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেছিলেন, ঈদযাত্রায় কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ কোনো ধরনের যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না। পণ্যবাহী যানবাহনে কিংবা অন্য কোনো যানবাহনের ছাদে, খোলা ট্রাক বা পিকআপে উঠতে পারবেন না। আমরা কোনোভাবেই এবার অনিরাপদ ঈদযাত্রা সহ্য করব না। আমরা এবার হাইওয়ে পুলিশ সড়কে কঠোর থাকব। যারা অনিরাপদ যানবাহনে যাত্রী উঠাবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু গতকাল মাগুরাগামী ইউনিক পরিবহণের সঙ্গে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে সড়ক অনিরাপদের ইস্যু সামনে এসেছে।

নিজেদের প্রমাণ করার সময় দেওয়া দরকার। আর যারা অনিবন্ধিত, আমি মনে করি, অবৈধভাবে কোনো কিছু সঠিক না, তারা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। সেগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবো। আর এটা আপনাদের (সাংবাদিক) দাবি। আমি কিন্তু বলছি না। কাজেই আমি সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আপনাদের দাবি পূরণের ঘোষণা দিচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, আমি চাই না, সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আমি ঘোষণা দিলাম যে, অনিবন্ধিত অনলাইন বন্ধ করে দেব, কালকে হেডলাইন করে পরের দিন আলাপ হবে, সরকার তো গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরছে। সেটা আমি চাই না। সাংবাদিকরাই এমনটা বলছেন।

এ সময় ওনাব সভাপতি মোল্লাহ এম আমজাদ হোসেন, সহসভাপতি লতিফুল বারী হামিম ও সৌমিত্র দেব, যুগ্ম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান ও আশরাফুল কবির আসিফ, কার্যনির্বাহী সদস্য নজরুল ইসলাম মিঠু, তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, রফিকুল বাসার, হামিদ মো. জসিম, মহসিন হোসেন, অয়ন আহমেদ, খোকন কুমার রায়সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।