স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশু পালন ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশুপালন ও মাংস প্রক্রিয়াকরণের তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সম্মতভাবে আমাদের পশু পাখিগুলোকে লালন পালন ও নিয়ম মেনে জবাই করতে হবে। অনেক দেশ হালাল মাংস আমাদের থেকে ক্রয় করতে চায়। সেই সুযোগ আমাদের নিতে হবে। প্যাকেটজাত করার ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে হচ্ছে কি না, সে বিষয় আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের (বিআইসিসি) পাশে শেরেবাংলা নগরের পুরোনো বাণিজ্য মেলা মাঠে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ‘প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পশুপালন ও মাংস উৎপাদন যদি করতে পারি তাহলে দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আমরা বিদেশেও রপ্তানি করতে পারব। এরই মধ্যে কিছু কিছু রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু আরো বেশি রপ্তানি করার সুযোগও আমাদের আছে, অনেক দেশের কাছ থেকে আমরা সেই অনুরোধও পাচ্ছি। আওয়ামী লীগ সরকার একটি প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যেসব পশু পালন করা হয় তা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পালনের ব্যবস্থা নিতে হবে। মাছ, হাঁস-মুরগি, পশু পালন এবং উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরনও স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে করতে হবে। এটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আরো যত্নবান হতে হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে হালাল মাংস রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ আমাদের রয়েছে।

তিনি বলেন, পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা যাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি সেজন্য কিছু আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন বুচার হাউস (কসাই খানা) আমাদের তৈরি করা দরকার। বিশেষ করে কোরবানির সময় রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে ফেলে পশু জবাই করা আমাদের বন্ধ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট একটি স্থান থাকবে যেখানে পশু জবাই হবে এবং যার যার চিহ্নিত পশু সে নিয়ে যাবে। তাহলে পুরো প্রক্রিয়া যেমন স্বাস্থ্যসম্মত হবে তেমনি পশুর পরিত্যক্ত অংশ এবং চামড়া যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাবে। না হলে চামড়ার মান নষ্ট হয় তেমনি অনেক কিছুই অপচয় হয়ে যায়। পশুর কেবল মাংসই আমাদের প্রয়োজন হয় না এর হাড়, রক্ত, চামড়া এমনকি বর্জ্যও আমাদের কাজে লাগে। আমরা যদি এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করতে পারি তাহলে আমাদের অনেক কাজে আসতে পারে। এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং কাজে লাগানোর ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে হবে।

দেশের পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদেরই নিজস্ব খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি চাই বেসরকারি খাত এগিয়ে আসুক। বেসরকারি খাতকেই উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চাই। তাদের সব রকম সহযোগিতা করতে চাই। এর ফলে আমার দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আমরা তাই চাই। আমরা বেসরকারি খাতকেই বেশি উৎসাহিত করতে চাই। তাদেরই বেশি সুবিধা দিতে চাই। কারণ, এগুলো সব সরকারিভাবে হয় না। এটা বেসরকারি খাতে হলে তাতে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়।

আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজ এক্ষেত্রে এগিয়ে আসুক সেটাই আমরা চাই।

সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার আহবান জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, শুধু একটা পাস করে চাকরির পেছনে না ছুটে, যুব সমাজ যদি নিজের উদ্যোগে একটু ব্যবসা-বাণিজ্য করে তাহলে কিন্তু আমরা যথেষ্ট এগিয়ে যেতে পারবো। এসব ক্ষেত্রে আমাদের যুব সমাজকে এগিয়ে আসার জন্য আরো উৎসাহিত করতে হবে। যাতে কখনো আমাদের কারো উপর নির্ভরশীল হতে না হয়।

প্রধানমন্ত্রী উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণার উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা আরো বাড়াতে হবে। আজ আমরা ৪০ ভাগের উপরে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারি। আমরা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চাই না। প্রতিটি পণ্য আমরা নিজেরাই উৎপাদন করব। সরকার খামারিদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার বলে আমি মনে করি এবং সংশ্লিষ্ট মহল এ উদ্যোগ নেবেন বলে আমি আশা করি।

তিনি বলেন, সরকার ৪৭০টি উপজেলায় ভ্রাম্যমান পশু চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এই ভেটেরনারি সেক্টরটার দিকে আরো দৃষ্টি দেয়া দরকার। আটটি বিভাগ ও ৬৪টি জেলায় ভেটেরনারি ফার্ম, পশু চিকিৎসালয় ও সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে হবে। ধান চালের পাশাপাশি পশু সম্পদ সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে হবে। যাতে কোনো সম্পদই যেন অপচয় না হয়। সেগুলোকে আমরা আর্থিক কাজে ব্যবহার করতে পারি সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। মৎস্য ও পশু পাখির খাদ্যও যেন নিরাপদ হয় এবং এগুলো যাতে পরবর্তীতে মানবদেহে কোনো রোগের সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প অনেক দূর এগিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পশু পাখির জন্য নিজেরাই নানা রকম ভ্যাকসিন তৈরি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি। এটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাংলাদেশ বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা অর্জন করলেও এখনো গভীর সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ করতে পারেনি। আসলে আমরা এই উদ্দেশে কোনো উদ্যোক্তা পাচ্ছি না। এটাই বাস্তবতা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ১৯৯৮ সালের প্রলংকারী বন্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকারের প্রচেষ্টায় বীজ ও কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় কৃষি সামগ্রি কৃষকের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়ায় এর পরই বাম্পার ফসল উৎপাদন হয়। যেখানে বিভিন্ন বিদেশি মিডিয়া বলেছিল ১ কোটি মানুষ এই বন্যায় না খেতে পেয়ে মারা যাবে, সেখানে একটি মানুষও না খেয়ে মরেনি। অথচ তিরি সরকার প্রধান হিসেবে সংসদে যখন দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হবার ঘোষণা দিলেন তখন বিরোধিদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তার সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ভালো না, তাহলে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবে না।’ আসলে এটা হচ্ছে নীতির বিষয়। তারা দেশকে অন্যে মুখাপেক্ষী করেই রাখতে চায়। সরকার প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানোর পাশাপাশি পরিত্যক্ত চরাঞ্চলে মহিষ, ভেড়া হাঁস-মুরগি চাষে উৎসাহিত করছে।

তিনি বলেন, এমনকি ভাষানচরে যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি সেখানেও প্রচুর ভেড়া ও মহিষ লালন পালন হচ্ছে। হাঁস-মুরগি প্রতিপালন ও মাছের চাষ হচ্ছে। আমরা এভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের যেটুকু মাটি ও সম্পদ রয়েছে তা ব্যবহার করেই আমরা স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারব। জনগণ মৎস, পশু ও হাঁস মুরগি পালনে আরো এগিয়ে আসবেন এবং আমাদের খামারগুলো আরো উন্নত হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম উদ্দিন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন দেশের ডেইরি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে এবং বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমান পোলট্রি খাতের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেন। শুরুতে প্রাণিসম্পদ খাতে বর্তমান সরকারের অগ্রগতি ও অর্জনের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এ আয়োজনের এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘প্রাণী সম্পদে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ।’ উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী প্রদর্শনীর বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।