ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইরান ভূ-খণ্ডে ইসরায়েলি ড্রোন নিক্ষেপ

প্রতিশোধ হামলা রূপ নিতে পারে রণাঙ্গনে

প্রতিশোধ হামলা রূপ নিতে পারে রণাঙ্গনে

নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে ইসরায়েল পার পেলেও ইরানের কনস্যুলেটে হামলার পর তা সম্ভব হয়নি। পাল্ট হামলা হিসেবে একযোগে তিন শতাধিক ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েলে। গতকাল ইরানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। প্রতিশোধমূলক পাল্টাপাল্টি হামলা চলতে থাকলে যেকোনো সময়ে ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর-আইআরজিসি) সদস্যসহ ১৩ জন নিহত হন। সেই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তিন শতাধিক ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েলে। প্রথমবারের মতো দীর্ঘদিনের বৈরী ইরান সরাসরি ইসরায়েলের সার্বভৌম ভূখণ্ডে আঘাত করে। ইরানের ড্রোন হামলার পর নিশ্চুপ ছিল না ইসরায়েল। তাই তো গতকাল ইরানে পাল্টা হামলা চালায় ইসরায়েল।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইরানে সরাসরি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এর সপ্তাহখানেক আগে গত শনিবার রাতে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল ইরান। তবে ইসরায়েলের সর্বশেষ এই হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্ররা ইরানে হামলার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলে ইসরায়েলের পাশে থাকবে না তারা। কিন্তু মিত্রদের সেই সিদ্ধান্ত উড়িয়ে দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কোনো দেশই ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের পর আরেকটি নতুন রণাঙ্গনের বোঝা বহন করার অবস্থানে নেই। কারণ, ইরানি নেতাদের বিভিন্ন প্রক্সি বা ছায়াশক্তি রয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতিদের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধ চলছে। ইরান এখন সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা শক্তিগুলো সুবিধা করতে পারেনি। আফগানিস্তানেও টিকতে পারেনি আমেরিকার সৈন্যরা। অন্যদিকে ফিলিস্তিনির গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী গণহত্যা চালালেও হামাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়েছে, যা ইসরায়েলের জন্য চরম ব্যর্থতা।

ইসরায়েলের বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক গবেষণাপ্রধান সিমা শাইন বলেছেন, ইসরায়েলি বাহিনী এতদিন ভাবতো ইরানের প্রতিশোধ নেওয়ার শক্তি নেই। ইসরায়েলি নেতাদেরও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ইরান যুদ্ধে জড়িত হতে চায় না। কিন্তু ইরান এখন সেই অবস্থানে নেই। ইসরায়েলে ড্রোন হামলার মধ্যদিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তেহরান।

ইরানের ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে না এলে এ হামলায় তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরা জানায়, ইরানের ছোড়া অন্তত ৯টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দুটি বিমানঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিস্তৃত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং ওই অঞ্চলে দেশটির মিত্রশক্তিগুলোর ছোড়া গুলি এড়িয়ে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়।

হামলার পর ইরানের হুমকি : গতকাল ড্রোন হামলার পর ইসরায়েলকে হুমকি দিয়ে ইরানের সামরিক বাহিনীর এলিট শাখা ইসলামিক রেভ্যালুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বলেছে, যদি দেশটির পরমাণু স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে কোনো হামলা চালানো হয় তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইআরজিসি টিমের প্রধান জেনারেল আহমেদ হাকতালাব এক বার্তায় বলেছেন, যদি জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠী আমাদের পরমাণু স্থাপনা ও কেন্দ্রগুলোতে কোনো প্রকার ক্ষতি সাধনের পদক্ষেপ নেয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা তার প্রতিক্রিয়া জানাব এবং সেই প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ।

ইসরায়েল যদি সত্যিই পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে, তাহলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন জেনারেল হাকতালাব। ইসরায়েলের ভুয়া জায়নবাদী গোষ্ঠী যদি ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য পারমাণবিক স্থাপনা ও প্রকল্প কার্যালয়ে হামলা করে, তাহলে ইরানও তার পারমাণবিক ডকট্রিন ও নীতি সংশোধন করবে এবং পূর্বঘোষিত বিবেচন্য বিষয়গুলো থেকে সরে আসবে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলেছে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইরানে সরাসরি হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানের ইসফাহানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যেখানে একটি বড় বিমান ঘাঁটির পাশাপাশি পারমাণবিক স্থাপনা রয়েছে। তবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কোনো ক্ষতি হয়নি। পারমাণবিক স্থাপনা স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন।

যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দেয় ইসরায়েল : ইরানে হামলা চালাতে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছে। নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা মার্কিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইসরায়েল তাদের হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়। তবে ওয়াশিংটন এই হামলার বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। সেজন্য হোয়াইট হাউজ এবং পেন্টাগন ওই হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। যদিও ইরান বলেছে, কয়েকটি ড্রোন দিয়ে হামলার চেষ্টা করা হয়েছে এবং এগুলো তারা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেশটির এক কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন গণমাধ্যমের খবর সত্য নয়।

ইরানের ইসফাহান টার্গেট কেন : ইসফাহান শহরটি ইরানের কেন্দ্রে অবস্থিত। এই শহরে পারমাণবিক স্থাপনাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। সেজন্য ইসরায়েল ইসফাহান শহরটি টার্গেট করে। একই সঙ্গে ইসফাহানের ওপরে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করা হয়। রয়টার্সের মতে, দেশের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার পর সেগুলো আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইরিব জানায়, ইসফাহান ও এর বসিন্দারা নিরাপদে আছে, সেখানে সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। তবে ইরানের বড় কয়েকটি শহরে বিমান চলাচল স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।

নাগরিকদের ইসরায়েল ছাড়তে বলল অস্ট্রেলিয়া : ইরানে ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য এবার নাগরিকদের ইসরায়েল ছাড়তে বলেছে অস্ট্রেলিয়া। এই অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা দেশটির। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলেছে, ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলার খবরের পর অস্ট্রেলিয়া তার নাগরিকদের ইসরায়েল ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সের স্মার্টট্রাভেলার অ্যাকাউন্টে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য বিভাগ বলেছে, ‘সারা অঞ্চলজুড়ে ইসরায়েল ও ইসরায়েলি স্বার্থের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিশোধ এবং সন্ত্রাসী হামলার উচ্চ হুমকি রয়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে।’

এতে আরো বলা হয়, ‘আমরা ইসরায়েল বা অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে থাকা অস্ট্রেলিয়ানদের ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’

এছাড়া আকাশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফ্লাইট বাতিল এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যাঘাতের বিষয়েও মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলে অবস্থানরত অস্ট্রেলিয়ানদের সতর্কও করেছে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য বিভাগ।

জ্বালানির দাম বাড়ল : ইরানে হামলার খবরের পর আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে তেল ও সোনার দাম। আন্তজার্তিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুডে তেলের দাম ১.৮% বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৮৮ ডলার হয়েছে। একই সঙ্গে সোনার দাম অল্প সময়ের জন্য রেকর্ড উচ্চতায় ওঠার পর আউন্স প্রতি ২ হাজার ৪০০ ডলারে পৌঁছেছে। স্থায়ীভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য তেলের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। জ্বালানি ও শক্তির দামই গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের পেছনে প্রধান চালিকা হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে বিশ্ব বাজারে অনিশ্চয়তার পরিস্থিতি তৈরি হলেই নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহৃত স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার ফলে ওমান ও ইরানের মধ্যে হরমুজ প্রণালী দিয়ে তেলের সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ, তেল সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ রুট এটি। বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এই লাইন দিয়ে হয়। ওপেকভুক্ত সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাকের বেশিরভাগ তেল হরমুজ প্রণালী দিয়ে সরবরাহ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুযায়ী, ওপেকভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তেল উৎপাদনে ইরান তৃতীয়। আর দেশটি বিশ্বের মধ্যে তেল উৎপদানে রয়েছে সপ্তম অবস্থানে। প্রাথমিকভাবে তেলের দাম বৃদ্ধি ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল বলে জানান জ্বালানি বাজার বিশেষজ্ঞ বন্দনা হরি।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য খাদের কিনারে। এ অঞ্চলের মানুষ একটি পূর্ণমাত্রার ধ্বংসাত্মক সংঘাতের মুখোমুখি। তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। এখনই সময় তাদের খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে আনার। আর এ দায়িত্ব যৌথভাবে সবার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত