ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রচণ্ড গরমে বাড়ছে দুর্ভোগ

* লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ জনজীবন * স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ * হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
প্রচণ্ড গরমে বাড়ছে দুর্ভোগ

দেশজুড়ে প্রচণ্ড গরমে প্রাণিকুলের হাঁসফাঁস অবস্থা। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহারে কিছুসংখ্যক মানুষ গরম থেকে রেহাই পেলেও তীব্র তাপপ্রবাহে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা। জীবিকার তাগিদে গরমে দিনমজুর ও রিকশা চালকরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জীবন। কোথাও নেই প্রত্যাশিত স্বস্তি। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় তাপপ্রবাহের সঙ্গে শরীর থেকে অতিরিক্ত ঘাম বেরিয়ে নাকাল অবস্থা। মাত্রাতিরিক্ত গরমে মানুষের রোগ-ব্যাধিও বেড়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে ১৫ এপ্রিল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। এই তীব্র তাপপ্রবাহ ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। আর গতকাল রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। এই তাপপ্রবাহের কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তর তিন দিনের জন্য (১৯ থেকে ২১ এপ্রিল) তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা বা হিট অ্যালার্ট জারি করে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আগামী দুই থেকে তিন দিন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা কম। হিট অ্যালার্টের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রচণ্ড গরমে শিশু ও বয়স্করা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। কেউ অজ্ঞান হলে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। শরীরের তাপ কমাতে ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে, প্রয়োজনে বরফ ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন বলেন, ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কিছু সময় পার করলেই শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এটি জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি।

সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অতিরিক্ত গরমে হাসপাতালে ভর্তি তাকা রোগীরা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন। নতুন করে গরমজনিত অসুস্থতায় সব বয়সি রোগীর চাপ বেড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে ২০৭ নম্বর ওয়ার্ডে শয্যা ও মেঝে মিলিয়ে ভর্তি আছে ৪৮টি শিশু। তাদের মধ্যে ২৩ জন গরমজনিত বিভিন্ন রোগে (জ্বর-সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া) আক্রান্ত। ঢাকা শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ১০২টি শিশু চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের অধিকাংশই জ্বর, ঠান্ডা, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। আর আইসিডিডিআরবিতে ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত প্রায় ৫ শতাধিক শিশু চিকিৎসা নিয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসক অর্মিতা মজুমদার বলেন, রোগীদের নিয়মিত হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে গরমের মধ্যে রোগী ডায়রিয়া, জ্বর ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা বেশি ভর্তি হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রচণ্ড গরমে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শিশুদের সহ্যক্ষমতা কম। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে শিশুরা বেশি অসুস্থ হচ্ছে। একই কথা বলেন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ। গরমে হাসপাতালে রোগী বাড়লেও বিদ্যুৎ সরবরাহ কমেছে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি মানুষের বাড়তি যন্ত্রণার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে গড়ে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না, কোথাও কোথাও ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ২৭৭ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট হয়েছিল। প্রচণ্ড গরমে দেশজুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গ্যাসের সরবরাহ আগের চেয়ে বেশি, হলেও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে; কিন্তু সরবরাহ বাড়েনি। এদিকে তীব্র গরমে বার বার লোডশেডিংয়ের কারণে হাঁসফাঁস করছে দেশের মানুষ। বিশেষ করে শিশু ও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভোগা মানুষরা বেশি কষ্টে আছেন। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা লুৎফর রহমান বলেন, প্রচণ্ড গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে অথচ বিদ্যুৎ থাকছে না। ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে বিদ্যুৎ থাকে না। খুব কষ্ট আছি। সম্প্রতি বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, মিশর, পাকিস্তান ও ইরাকের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গবেষণা করেছে। এতে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে থাকা দেশের ১৭টি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে তাপমাত্রার তথ্য নেওয়া হয়েছে। তারা ১৯৬১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা ও আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষকেরা বলছেন, গত ছয় দশকে ঢাকায় অসহনীয় গরম তিন গুণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী আরবান ক্লাইমেট এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটির শিরোনাম ‘চেঞ্জেস ইন হিউম্যান ডিসকমফোর্ট অ্যান্ড ইটস ড্রাইভার ইন বাংলাদেশ’।

প্রথমত গরমে অস্বস্তি সূচক-ডিআই, দ্বিতীয়ত আর্দ্রতার ঘনীভূত রূপ বা হিউমিডেক্স ও তৃতীয়ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার মিশ্রণে যে কষ্টের তীব্রতা বাড়ে, যাকে গবেষকরা বলছেন ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার (ডব্লিউবিটি)। ওই তিনটি সূচকে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন গরমের কষ্ট বা অনুভূতি দ্রুত বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ বছরে বাংলাদেশে দশমিক ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বাড়ছে। আর আর্দ্রতা বাড়ছে দশমিক ৩ শতাংশ হারে। আর আর্দ্রতার মিশ্রণে কষ্টের তীব্রতা (ডব্লিউবিটি) বেড়েছে দশমিক ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত