সহসা কাটছে না দাবদাহ

* এপ্রিলকেন্দ্রিক কর্ম পরিকল্পনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের * হাসপাতালে শয্যা খালি রাখার নির্দেশ * শীতাতপ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে

প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দেশজুড়ে দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে গরমে চরম অবস্থা প্রাণিকূলে। চলমান তীব্র দাবদাহ থেকে সহসায় রেহাই মিলবে না। সেজন্য অতি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত শয্যা খালি রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে যেসব রোগীদের অপারেশন এক মাস পর করলেও চলবে, তাদের এখন হাসপাতালে ভর্তি যেন না রাখা হয়।

রাজধানীর মাতুয়াইলের আমান সিটি এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন শহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, জীবিকার তাগিদে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে কাজে এসেছেন। সকালে রোদ ওঠার আগে কিছুটা কাজ করা যায়। বেলা গড়িয়ে রোদ বাড়ার পর আর পারি না। খুব কষ্ট হয়। তীব্র রোদে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নির্মাণকাজ বন্ধ রেখে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে হয়। শহিদুল ইসলাম বলেন, রোদে ক্লান্তি লাগছে, মাথা ঘুরাচ্ছে। সেজন্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কাজ করছি। বাতাস বইছে কিন্তু তা গরম। ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি। তীব্র রোদে পুড়ে কাজ করতে হচ্ছে। শহিদুলের মতো দিনমজুর মানুষ জীবিকার টানে তীব্র গরমে কাজে বের হয়েছেন।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকালের ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- দেশজুড়ে তীব্র দাবদাহে কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। পাবনা, যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী জেলাসহ খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফেনী, কক্সবাজার, চাঁদপুর ও রাঙ্গামাটি জেলাসহ বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। আজ ও আগামীকাল একই মাত্রায় দাবদাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, এপ্রিল মাসে দেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা আছে।

গতকাল সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সারা দেশের হাসপাতালের পরিচালক, সিভিল সার্জনদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা। বয়স্ক এবং শিশুরা প্রয়োজন ছাড়া যেন বাড়ি থেকে বের না হয়। হাসপাতালগুলোর বেড খালি রাখার জন্য যেসব রোগীর অপারেশন এক মাস পরে করলেও চলে কিংবা এখন ভর্তি না করালেও চলবে তাদের এখন যেন না রাখে। যদি চাপ তৈরি হয় তখন যেন শিশু এবং বয়স্কদের ভর্তি করানো যায়। সার্বিক পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।

সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আইসিডিডিআরবি এক যৌথ পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে ইনফ্লুয়েঞ্জা (শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ) হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা, পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা, খারাপ লাগা বোধ করা, গলাব্যথা ও নাক দিয়ে সর্দি ঝরার মতো লক্ষণ দেখা দেয় অর্থাৎ ইনফ্লুয়েঞ্জা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, তীব্র দাবদাহে মানুষের দেহে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এমন অবস্থায় হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি হয়। সেজন্য অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া উচিত নয়। মানবদেহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। দীর্ঘ সময় গরমে থাকায় শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে হিট স্ট্রোক হয়। শিশু, নারী ও বয়স্কদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস রোগীদের সতর্ক থাকতে হবে।

তীব্র গরম থেকে মানুষ রেহাই পেতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বাড়িয়েছে। এতে কয়েক দিনের ব্যবধানে ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ঘাটতিতে লোডশেডিং দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গতকালের বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারের তথ্য বলেছে, গত ১৪ এপ্রিল দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। গতকাল বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে। এই চাহিদার পরিমাণ গত এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ঢাকা পল্টন এলাকার বাসিন্দা কাজল সরকার বলেন, বাড়ি কিংবা অফিস থেকে সড়কে বের হলেই প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে আগুনের ফুলকির মতো বাতাস শরীরে লাগছে। এতে দরদর করে ঝরছে ঘাম। আবহাওয়ার চিত্র দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

গত ১০ বছরে তাপপ্রবাহ বইছে। এপ্রিলের পাশাপাশি মে মাসেও থেমে থেমে দাবদাহ বয়ে যাবে। পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উঠলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ঘোষণা করা হয়। আর তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর আর্দ্রতা ৩০-এর ওপরে গেলে একে বিপজ্জনক আবহাওয়া হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, এপ্রিল মাসের আবহাওয়া অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অন্যান্য কারণে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই সময়ের জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও গবাদিপশুর সুরক্ষার জন্য দ্রুত পরিকল্পনা নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ডিজাস্টার সায়েন্স ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পর সচেতনতা বেড়েছে, মৃত্যু কমেছে। এপ্রিল মাসের দাবদাহকেও গুরুত্বপূর্ণ দুর্যোগ হিসেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে।