ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বৈশ্বিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশ

* বাড়ছে তাপমাত্রা লবণাক্ততা ও কার্বন ডাই অক্সাইড * সবুজায়ন হারিয়ে রুক্ষ হচ্ছে পরিবেশ
বৈশ্বিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশ

দেশজুড়ে প্রতি বছর জলাশয় ভরাট, পিকনিক স্পট ও বিনোদন কেন্দ্রসহ হাউজিং প্রকল্প গড়ে উঠছে। এতে কাটা পড়ছে গাছপালা। নষ্ট হচ্ছে সবুজায়ন, রুক্ষ হচ্ছে পরিবেশ। ফলে এপ্রিল মাস এলেই তীব্র গরম পড়ছে। প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশজুড়ে বিভিন্ন কারণে গাছপালা কাটা হচ্ছে, জলাশয় ভরাট চলছে, গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহারও আকাশচুম্মি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েই চলছে। পরিবেশ রক্ষায় এখনই উদ্যোগ না নিলে সামনের দিনগুলোয় তাপপ্রবাহ আরো বাড়বে।

মানুষের বাঁচার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন ও নির্মল বায়ু। আর এই অক্সিজেনের ৭০ ভাগ জোগান আসে গাছপালা থেকে। কিন্তু গাছপালা কমে যাওয়ায় বাড়ছে বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা। একই সঙ্গে জমিতে লবণাক্তের পরিমাণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে লবণাক্ত প্রভাবিত জমির পরিমাণ ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর ছিল। ২০০৯ সালে এসে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর লবণাক্ত জমি। বছরের পর বছর এভাবেই ক্রমাগত লবণাক্ত প্রভাবিত জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণাক্ততা বাড়ায় সুন্দরবন উপকূলে ৭৩ শতাংশ পরিবার সুপেয় পানির সংকটে আছে। গত ৩৫ বছরে উপকূলীয় অঞ্চলে আগের তুলনায় লবণাক্ততা বেড়েছে ২৬ ভাগ। লবণাক্তে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার বাংলাদেশের মানুষ। জানা গেছে, দেশজুড়ে প্রতিনিয়ত যানবাহন ও কলকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। এসব যানবাহন ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণ করছে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়চ্ছে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি থাকলে ক্ষতিকর। তবে গাছপালা, বন বেশি থাকলে সমস্যা তীব্র হতো না। কারণ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস আবার গাছপালার খুব প্রয়োজন। আমরা আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ি। সেজন্য বেশি বেশি গাছ লাগিয়ে কলকারখানার কালো ধোঁয়া রোধ করা প্রয়োজন।

এসব বিষয়ে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ ছিল, যা বর্তমানে চার ঋতুতে পরিণত হয়েছে। আষাঢ়েও এখন আর বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায় না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল সমুদ্রগর্ভে বিলীন হলে লবণাক্ততা বেড়ে আরো ভেতরে ঢুকে যাবে।

তিনি আরো বলেন, প্রকৃতির সুন্দর পরিবেশ না হলে মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর। পরিবেশ সচেতনতা ও সবুজায়ন সম্পর্কে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি গ্রামে একটি সর্বদলীয় পরিবেশ কমিটি ও নার্সারি গড়ে তুলতে হবে। বৃক্ষনিধন, পাহাড় কাটা, বন উজাড়কারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

কোনো এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলে খরা বেশি হয়। এতে খাদ্যাভাব, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ভূমিহীনতা এবং নানা প্রকার সামাজিক সংকট বাড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে মাঝারি ধরনের খরা উপদ্রুত যেসব এলাকা রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা মারাত্মক খরাকবলিত এলাকায় পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ, নদীশাসনের প্রভাবজনিত কারণে বাংলাদেশের বিপদ কয়েক গুণ বেড়েছে। বিভিন্ন সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজারের পাশঘেঁষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পান্থকুঞ্জ পার্কে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো ছিল। কিন্তু উন্নয়নের নামে পার্কের গাছগুলো কাটা পড়েছে। এভাবেই উন্নয়নের নামে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গাছ কাটা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলামোটরের বাসিন্দা কাজী জেবেল বলেন, পান্থকুঞ্জ পার্কের গাছ কাটার পর এই এলাকায় তাপ বেড়ে গেছে। আগে গরমে পার্কে ঢুকে গাছের ছায়ায় আরাম করা যেত, এখন ঢোকাও যায় না। রাজধানীর শাহবাগ এলাকার শিশুপার্কের অবস্থার চিত্র একই। ফার্মগেটে আনোয়ারা উদ্যান নামে থাকলেও বাস্তবে ফাঁকা। সেখানে মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেও বেশ কিছু গাছ ছিল, যা কেটে ফেলা হয়েছে। পার্ক, উদ্যান ছাড়াও সড়কের পাশে লাগানো গাছপালাও কেটে ফেলা হয়েছে।

পার্ক উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা উন্নয়নের নামে ঢাকা শহরের বহু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও ঢাকা শহরে প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে। অথচ রাজধানী শহরসহ সারা দেশে যে তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, ছায়া দেওয়ার মাধ্যমে তা থেকে সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই গাছ।

বিশ্বের জনবহুল শহরগুলো মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এই শহরে মানুষের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহন ও অবকাঠামোর চাপ বেড়েছে। এই বাড়তি চাপ সামলাতে গাছ কেটে রাস্তা ও ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম।

গত একদশকে ঢাকা শহরে সবুজের পরিমাণ যে ব্যাপকভাবে কমেছে, তা উঠে এসেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণায়। ‘ঢাকা শহরের বায়ু, পরিবেশ ও বাসযোগ্যতা’ শিরোনামের সেই গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ২০০৯ সালে সবুজের আচ্ছাদন ছিল ১২ দশমিক ৪৫ বর্গকিলোমিটার, যা শহরের ৯ দশমিক ২৯ শতাংশ। এক দশক পর ২০১৯ সালে ঢাকা শহরে সবুজের আচ্ছাদন কমে ১২ দশমিক ৩৩ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। সবুজের মতো খারাপ অবস্থা জলাশয়েরও। বিআইপির ‘ঢাকা শহরের বায়ু, পরিবেশ ও বাসযোগ্যতা’ গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ২০০৯ সালে জলাভূমি ছিল ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ঢাকায় মানুষের চাপ বাড়লেও কমছে গাছপালা ও জলাভূমি। পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। সেজন্য বছরের পর বছর যে যেভাবে পারছে, অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করছে। এতে মানুষের গরমের কষ্ট বাড়ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত