ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকা ছাড়লেন কাতারের আমির

সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে দেশের অর্থনীতিতে

বাড়বে শ্রমবাজার, প্রসার ঘটবে বাণিজ্যে
সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে দেশের অর্থনীতিতে

বিশ্ব আজ পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেই পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করতে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। তার এই সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যকার অর্থনীতি ও শ্রম বাজারে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একান্ত বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় আলোচনা হয়েছে। গত সোমবার বিকালে দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন কাতারের আমির। প্রায় দুই দশক পর কাতারের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশের সফর এটি, যা বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বড় অর্জন বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করতে পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। ‘বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে দ্বৈত কর পরিহার এবং রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ’, ‘বাংলাদেশ সরকার এবং কাতার রাষ্ট্রের মধ্যে আইনি ক্ষেত্রে সহযোগিতা’, ‘কাতার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্র পরিবহন’, ‘বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা’ এবং ‘বাংলাদেশ-কাতার যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠা’র বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। যার মধ্যে রয়েছে- জনশক্তি কর্মসংস্থান (শ্রম), বন্দর (এমব্লিউএএনআই কাতার এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ), বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে এবং বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতার স্মারক।

কাতার আমিরের এ সফরে ব্যবসা বাণিজ্য, জনশক্তি রপ্তানি এবং মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার এখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করায় এই গুরুত্ব আরো বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কও জোরদার করতে চায় দেশটি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কাতারের বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর, বন্ধুত্বপূর্ণ ও বহুমুখী। এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অত্যন্ত চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সেটি আরো উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, গার্মেন্টস তো আছেই, এছাড়া আমাদের সিরামিক প্রোডাক্টস, ওষুধ-সহ আরো অনেক নন-ট্রাডিশনাল আইটেম আছে। সেগুলোর রপ্তানি আরো বাড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি।

জানা গেছে, কাতারের আমিরের সফরের মধ্যদিয়ে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের জন্য বড় সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে সরকার। বিপুল পরিমাণ সার্বভৌম তহবিলের অধিকারী কাতার বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বিনিয়োগের উৎস হিসেবে দাঁড়াবে। এরই মধ্যেই কাতারের বন্দর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান মাওয়ানি বাংলাদেশে বন্দর ব্যবস্থাপনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটি মহেশখালীর মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন বন্দরের ব্যবস্থাপনা করতে চায়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বন্দর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কাতারের বিশ্বব্যাপী সুনাম আছে। কাজেই কাতার যদি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়, সেটি অবশ্যই ভালো খবর। কাতার জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করছে, কাজেই তাদেরকে সরকার বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের প্রতি আকৃষ্টের চেষ্টা করা যেতে পারে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, কাতারের আমিরের বাংলাদেশ সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এলএনজি আমদানি ছাড়াও কাতারে আমাদের বহু শ্রমিক কাজ করেন। সেজন্য দুই দেশের সম্পর্ক ভালো থাকা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে কাতার বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে নবম অবস্থানে আছে। চলতি অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ৯ মাসে প্রবাসীরা ওই দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৮৩৮ দশমিক ২২ মিলিয়ন ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতারের অবস্থান সপ্তম। ২০০১ সাল থেকে কাতারে জনশক্তি রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে ২০১৫-১৬ সালে আবার ভালো অবস্থানে চলে আসে। এরপরের চার বছর আবার কমে যায়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৬ হাজারেরও বেশি জনশক্তি কাতারে গিয়েছে।

কূটনীতিবিদরা বলেছেন, কাতার আমিরের ঢাকা সফর সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছিল।

সুতরাং, শ্রমশক্তি পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুবিধা। কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বাড়লে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নানা সুবিধা নিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

কাতার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করতে ২০১৭ সালে ১৫ বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৪০ কনটেইনার জ্বালানি আমদানি করছে সরকার, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন-সহ নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এখন বাংলাদেশ আরো অধিক এলএনজি সরবরাহ চায়। সেই লক্ষ্যে গত বছর কাতারের সাথে দীর্ঘমেয়াদি একটি চুক্তিও করে সরকার। সেই চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছর কাতার থেকে অতিরিক্ত ১ দশমিক ৮ এমএমটি এলএনজি পাবে, যার সরবরাহ শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে শুরু করেছে। ফলে ২০২৬ সালের আগেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহের চেষ্টা করা হবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, সরকারি হিসেবে কাতারে বর্তমানে ৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মরত, যাদের বেশির ভাগই গেছেন অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। ফলে অন্যান্য দেশের দক্ষ শ্রমিকদের তুলনায় তারা সেখানে কম বেতন ও অন্যান্য সুবিধাও কম পেয়ে থাকেন। কাতার দক্ষ শ্রমিক নেয় ভারত-পাকিস্তান থেকে। বাংলাদেশের অদক্ষ শ্রমিক বেশি কাজ করেও পর্যাপ্ত রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের উচিত দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির ব্যাপারে কাতারের সহযোগিতা নেওয়া। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিক রয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, কাতারে জনশক্তি পাঠানোর প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ধীর গতিতে বাংলাদেশের কর্মীরা যাচ্ছেন। এই প্রক্রিয়া সহজ করলে জনশক্তি যাওয়া বাড়বে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটিই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর। সব মিলিয়ে কাতারের আমিরের এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা নেয় বাংলাদেশ সরকার। সংক্ষিপ্ত সফর শেষে গতকাল সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা ত্যাগ করেন কাতারের আমির। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান। এর আগে ২০০৫ সালে কাতারের তৎকালীন আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি বাংলাদেশে এসেছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত