ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক

জানালেন সহিংসতার আশঙ্কা তবুও দিলেন না নির্দেশনা

জানালেন সহিংসতার আশঙ্কা তবুও দিলেন না নির্দেশনা

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। কিন্তু কোন গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিনি এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন তা উল্লেখ করেননি। অংশিজনদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেও সহিংসতা নিরসনে কোনো নির্দেশনা দেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে বিএনপি কোনো প্রার্থী দেয়নি। এখন পর্যন্ত ভোট নিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে আশঙ্কার কোনো কথা জানানো হয়নি। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে সিইসি উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা হবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করলেন তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সিইসির এমন বক্তব্যে ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে পারে বলে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, যে নির্বাচনে কোনো প্রতিযোগিতা নেই সেখানে বড় ধরনের সহিংসতা কীভাবে হবে। তিনি বলেন, স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যানের মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। তবে তার কোনো সুরাহা করা হয়নি। উপজেলা নির্বাচনের চলমান ধরন সম্পর্কে ড. তোফায়ের আহমেদ বলেন, ‘উপজেলা পরিষদকে যে অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে তা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। উপজেলা পরিষদকে অকার্যকর রেখে শুধু নির্বাচন-সর্বস্ব পরিষদ দিয়ে কী হবে! সিস্টেম উন্নয়নে যেন কারো কোনো আগ্রহ নেই। নির্বাচনে মুখ দেখানো নেতা হলাম, সেটাকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ালাম, এটাই যেন সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, তারা এসব অর্থসম্পদ যে উপজেলা পরিষদ থেকে অর্জন করেন, তা নয়। চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান হয়ে নেতা সেজে এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে নানা উপায়ে তারা এ সব অর্থসম্পদ অর্জন করেন।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে উপজেলা পরিষদ সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষ্যে সব বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, জেলা প্রশাসক, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি।

বৈঠকে সিইসি বলেন, যে কোনো মূল্যে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। সুষ্ঠু ভোটে ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের নির্বাচনে আবেগ অনুভূতির জন্য কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। যে কোনো মূল্যে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। এই নির্বাচনে ব্যর্থ হলে বিগত সংসদ নির্বাচনে যে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারি যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ব্যর্থ হবে। উপজেলা ভোট ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

জানা যায়, প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। প্রথম ধাপের ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, মনোনয়ন ফরম জমার শেষ দিন ছিল ১৫ এপ্রিল। মনোনয়ন ফরম যাচাই-বাছাই করা হয় ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। মনোনয়ন ফরম প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ২২ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ ২৩ এপ্রিল। আর ভোট হবে ৮ মে। এছাড়া প্রথম ধাপে বৈধ প্রার্থী এক হাজার ৭৮৬ জন, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের তারিখ ছিল ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল। আপিল নিষ্পত্তি হয় ২১ এপ্রিল। আর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল ২২ এপ্রিল।

এ ধাপের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করেন আপিল কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসক।

দ্বিতীয় ধাপের তপশিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল ২১ এপ্রিল, মনোনয়নপত্র বাছাই করা হয় ২৩ এপ্রিল, আপিল গ্রহণের সময়কাল ছিল ২৪-২৬ এপ্রিল, আপিল নিষ্পত্তি করার সময় ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৩০ এপ্রিল, প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে ২ মে। আর ১৬১ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে ২১ মে।

এ ধাপের নির্বাচনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় ধাপের তপশিল অনুযায়ী, মনোনয়ন ফরম জমার শেষ তারিখ ২ মে। মনোনয়ন যাচাই-বাছাই করা হয় ৫ মে। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ৬ থেকে ৮ মে। আপিল নিষ্পত্তি ৯ থেকে ১১ মে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১২ মে। প্রতীক বরাদ্দ ১৩ মে এবং ভোট ২৯ মে। এ ধাপে ১১২ উপজেলায় ভোট হবে।

এ ধাপে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত জেলা ও অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

চতুর্থ ধাপের তপশিল অনুযায়ী, আগামী ৫ জুন দেশের ৫৪ উপজেলায় চতুর্থ ধাপের ভোটগ্রহণ হবে। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার প্রার্থীর মৃত্যুতে স্থগিত হওয়া ভোটও এ ধাপে অনুষ্ঠিত হবে, ফলে মোট ৫৫ উপজেলায় ভোট। চতুর্থ ধাপে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ৯ মে, মনোনয়ন যাচাই-বাছাই ১২ মে। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ১৩ থেকে ১৫ মে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৯ মে। প্রতীক বরাদ্দ ২০ মে আর ভোটগ্রহণ হবে ৫ জুন। ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম জানিয়েছেন, চতুর্থ ধাপে ৯টি উপজেলায় ভোট হবে ইভিএমে। বাকিগুলোতে ভোট হবে ব্যালট পেপারে।

জানা যায়, বর্তমান সিইসি এর আগেও নানা অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তার সবচেয়ে আলোচিত উক্তি হচ্ছে- ‘তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন’ এই মন্তব্যের জন্য সিইসি যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছেন। পরে অবশ্য তিনি তার এই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল- সিইসির বক্তব্য ‘বিকৃত ও ভুলভাবে’ ব্যাখ্যা করে ‘অসত্য’ সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন একটি কেন্দ্রে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম ঘুষিতে আহত হওয়ার পর ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানান সিইসি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়- সিইসি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে জানতে চান- ‘উনি (ফয়জুল করীম) কি ইন্তেকাল করেছেন?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ‘তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল বা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানো’ বক্তব্যের বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার এ বক্তব্যের পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায়, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রধানের এ ধরনের বক্তব্য সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার শামিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের অংশ হিসেবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সংলাপে সিইসি বলেছিলেন- ‘সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাব। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব?’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের দেয়া একটি বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে রাশিয়া। সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। জেলেনস্কিকে নিয়ে সিইসির বক্তব্যে বিষ্ময় প্রকাশ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক বার্তা পাঠান ঢাকাস্থ রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মান্টিটস্কি। সিইসির বক্তব্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান হিসেবে বিবেচনায় নেয় রুশ দূতাবাস। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনের আগে সিইসিকে যে কোনো জনসংযোগ কার্যক্রমে তাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। তার এমন কোনো বক্তব্য দেয়া উচিত হবে না, যা আওয়ামী লীগবিরোধী পক্ষ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত