ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ

বিএনপির বহিষ্কারাদেশ কৌশলগত সিদ্ধান্ত!

বিএনপির বহিষ্কারাদেশ কৌশলগত সিদ্ধান্ত!

ভোটমুখী হচ্ছে বিএনপির তৃণমূল। মানছে না কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই ভোটের লড়াইয়ে শামিল হতে চাচ্ছে দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এরইমধ্যে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে শুরু করেছে দলটির স্থানীয় নেতারা। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় এরইমধ্যে তৃণমূলের ৭৩ জন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। গত শুক্রবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিএনপির যেসব নেতৃবৃন্দ উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার হওয়াদের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৮ জন, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ২৪ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ২১ জন রয়েছেন। এর আগের দিন উপজেলা পরিষদের ভোটে অংশ নিতে চাওয়া ৬৪ নেতাকে শোকজ করে বিএনপি। চিঠিতে নেতাদের ৪৮ ঘণ্টার সময় দিয়ে উত্তর দিতে বলা হয়। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, শোকজ করা ৬৪ নেতার মধ্যে ২৪ জন চেয়ারম্যান পদে ও ২১ জন ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৯ জন রয়েছেন।

বিএনপির বহিষ্কৃতদের মধ্যে ২৮ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তারা দলের বহিষ্কারাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যস্ত এবং শেষপর্যন্ত ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে চান তারা। যে ৭৩ জনকে বিএনপি বহিষ্কার করেছে, এর মধ্যে ২১ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রয়েছেন। একজন বহিষ্কার হওয়া মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি এর বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করব না। স্থানীয় প্রেক্ষাপট এবং আমার ব্যক্তিগত কারণে আমাকে নির্বাচনটা করতে হচ্ছে। আমি একনাগাড়ে তিনবারের ভাইস চেয়ারম্যান। এটুকু বলব, আমি দলকে ভালোবাসী, এলাকার মানুষও আমাকে অনেক ভালোবাসেন।’

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, ভোটে অংশ নেওয়া দলের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের বহিষ্কার করার মধ্য দিয়ে কার্যত বিএনপি মাঠপর্যায়ে চরম বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছে। এই বহিষ্কারাদেশ আগামী ৮ মে প্রথম ধাপের নির্বাচনের প্রার্থীদের জন্য। এরপর ২১ মে দ্বিতীয় ধাপসহ মোট চার ধাপে উপজেলা নির্বাচন রয়ে গেছে। সেখানেও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের অনেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। মূলত দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার্থে একসঙ্গে ৭৩ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। যাতে আগামী ধাপের নির্বাচনগুলোর ব্যাপারে নেতারা সতর্ক হন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবার উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার প্রশ্নে শুরু থেকেই বিএনপির নেতৃত্ব কঠোর অবস্থান নেয়। দলের অবাধ্য হয়ে যারা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন, তাদের ফেরানোর নানা চেষ্টা-তদবির করে ব্যর্থ হওয়ার পর গত শুক্রবার একযোগে বহিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বহিষ্কৃত নেতাদের নামের তালিকাও পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ ছাড়া নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, যেসব কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেনি, সেসব কারণ এখনো বহাল; বরং একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল আরো বেপরোয়া হয়েছে। এখনো হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবন্দি, সারা দেশে লাখ লাখ নেতাকর্মী আদালতে ঘুরছেন। এর বিরুদ্ধে বিএনপিসহ সববিরোধী দল আন্দোলনে আছে। এ পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে। কিন্তু গত ৭ জানুয়ারির বিএনপির নির্বাচনকে কেন্দ্র বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে যখন হতাশা তৈরি হয়েছে, অনেক নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতি উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে বড় সংখ্যায় বহিষ্কার করার এই অবস্থান দলকে আরো দুর্বল করবে কি না, এই প্রশ্নেও আলোচনা রয়েছে বিএনপিতে। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কঠোর অবস্থান নিয়েই এগোতে চাইছেন। ফলে উপজেলা ভোটে অংশগ্রহণের প্রশ্নে ভিন্নমত দলটিতে গুরুত্ব পাচ্ছে না বলেও বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলছেন।

সূত্রমতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির স্থানীয় নেতারা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রথম দিকে অংশ নিলেও ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সব স্থানীয় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় কুমিল্লার মনিরুল হক সাক্কু, নারায়ণগঞ্জের তৈমুর আলম খন্দকারসহ অনেককে দলীয় পদপদবি থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। সেই থেকে পরবর্তী সময়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বর্জন করে আসছে দলটি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ও মিত্ররা। উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একই অবস্থান বজায় রেখেছে দলটি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যেসব স্থানীয় পর্যায়ের নেতা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তাদের ভাগ্যে বহিষ্কারের খড়ক নেমে আসল। স্থানীয় পর্যায়ে যারা রাজনীতি করেন তারা সারা বছর নেতাকর্মীদের লালন-পালন করে থাকেন। তাদের সঙ্গে এলাকার উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেন। এলাকার উন্নয়ন করার জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে হয়। বিএনপির নেতারা বিগত ১৫ বছর নির্বাচনে নেই। লন্ডনে বসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় বিএনপির নেতারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। ফলে জনগণের খেদমত করার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। নির্বাচনে অংশ নেয়ার মধ্যেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনীতি হারিয়ে যায়। নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করা সম্ভব। সরকারের সমালোচনা করায় বিরোধী মতাদর্শের কোনো জনপ্রতিনিধি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এমন নজির বাংলাদেশে আছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছেন। এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে বসেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এও বলছেন, স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের বহিষ্কারাদেশ কৌশলী সিদ্ধান্তও হতে পারে। একদিকে, বহিষ্কার করে দেখাল নির্বাচনে অংশ নিল না, আরেকদিকে বহিষ্কারের কিছু দিন পর ভেতরে ভেতরে তাদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নিল। এমন নজির বিএনপিতে এর আগে দেখা গেছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমাদের আগের সিদ্ধান্তই বহাল আছে। এখন পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাব না। কারণ এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন কখনো অবাধ সুষ্ঠু হয় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত