ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সবুজায়ন হারিয়ে বিপর্যয়ে পরিবেশ

* কয়েক বছর ধরে বৈশাখ মাসে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে * প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর হস্তক্ষেপ নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল
সবুজায়ন হারিয়ে বিপর্যয়ে পরিবেশ

স্বল্প ভূমি সঠিকভাবে ব্যবহারের অভাবে বছরের পর বছর সড়ক উন্নয়ন, মানুষের বাসস্থান এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে গাছপালা কাটা পড়ছে। এতে সবুজায়ন হারিয়ে চরমভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে পরিবেশ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গা ছিল ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সর্বোনিম্ন তাপমাত্রা ছিল সিলেটে ২২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ চলতি মাসে যে তাপমাত্রা চলছে, তা আগামী কয়েক দিনেও কমার কোনো সম্ভবনা নেই।

পরিবেশবিদরা বলেছেন, আগে বৈশাখের শুরুতে কালবৈশাখি ঝড় ও বৃষ্টির দেখা মিলেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বৈশাখ মাসে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে। এবারো দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হয়েছে, যা গত বছরের বৈশাখের তুলনায় সামান্য। এভাবে বছরে বছরে বৃষ্টি কমছে, একসঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ছে। সেজন্য সবুজায়নকে বাদ দিয়ে প্রকল্প-নির্ভর উন্নয়নের পরিণাম ভয়াবহ। ক্রমবর্ধমান অসহনীয় তাপমাত্রার পেছনে রাজধানীর পরিবেশ বিপর্যয় প্রমাণ স্বরূপ।

সবুজায়নকে অস্বীকার করে সামগ্রীক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এর মধ্যেই তীব্র গরমে আবহাওয়া অধিদপ্তর হিট অ্যালার্টের মেয়াদ আরো তিন দিন বাড়িয়েছে। দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ গতকাল (২৮ এপ্রিল) থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা (তিন দিন) অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে। প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পাচ্ছে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ। অধিকাংশ অঞ্চলে তাপদাহের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে গত শনিবার ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং কর্মক্ষেত্রে জৈব রাসায়নিক দূষণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওশি) নামের সংগঠন বলেছে- দাবদাহের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর উৎপাদনশীল খাতে ক্ষতি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শুধু পোশাক খাতেই ৬০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হবে। এতে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন প্রায় আড়াই লাখ পোশাক কর্মী।

মানুষ নিবিঘেœ গাছপালা কাটছে এবং জলাশয় ভরাট করছে, এতে বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। প্রকৃতির ওপর নানাভাবে নেতিবাচক হস্তক্ষেপ করার ফলে প্রকৃতির চিরায়িত চলমান ধারায় বিঘ্ন ঘটছে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকছে না। অসৎ উদ্দেশ্য ও লোভের বশীভূত হয়ে মানুষের হরদম গাছপালা নিধন দেখে মনে হয় এই যেন মানুষ পৃথিবী ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশবাদীদের নানা কর্মসূচি, আন্দোলন প্রতিবাদ, আন্তর্জাতিক নানা চুক্তি ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের সরব উপস্থিতি থাকলেও মানুষ আইন কানুন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে প্রতিনিয়ত পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।

পাহাড়কাটা, বৃক্ষনিধন, বনউজাড়, নদী-খাল-বিল-ডোবা-নালা-পুকুর ভরাটসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেন নিত্যদিনের ঘটনা। উন্নয়ন ও নগরায়ণের নামে নির্বিচারে গাছপালা কেটে যত্রতত্র কলকারখানা নির্মাণ ও বসতি স্থাপন করছে। এটা প্রাকৃতিক পরিবেশকে গলা টিপে হত্যা করার পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়। নদীর স্রোত নিয়ন্ত্রণ, নদীর ওপর কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা এটা প্রকৃতির ওপর মানুষের একধরনের হস্তক্ষেপ, যা পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টের অন্যতম কারণ। ফলে দেশে দেশে পানি সংকট, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। প্রকৃতি ও পরিবেশর ওপর হস্তক্ষেপ নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল।

তাপদাহ, বন্যা, খড়া, পাহাড়ধস, নদী ভাঙন, ভূমিকম্প, দাবানল, আগ্নেয়গিরিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ভাবাস। কারণে কিংবা অকারণে গাছ কটায় প্রকৃতি ঠিকই প্রতিশোধ নিচ্ছে।

বাঁচতে হলে পরিবেশ বাঁচাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গাছপালা নিধন, বনজ সম্পদ দহন, জৈব জালানির ব্যবহার, আগ্নেয়গিরি ও দাবানলের কারণে পৃথিবীতে দিনদিন কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠ ক্রমশই উত্তপ্ত হচ্ছে।

চলমান তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে জন ও নগর জীবন অতিষ্ট। সবাই এখন এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষায়। সেচের অভাবে কৃষক চাষাবাদ শুরু করতে পারছে না। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুরও পরিবর্তন ঘটছে। অন্যদিকে ঋতুর পরিবর্তনে চাষাবাদের সময়ের পরিবর্তন ঘটছে। ফলে খাদ্য শষ্য ও ফসল উৎপাদনে ব্যতয় ঘটছে। এইসব পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টের কুফল। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও পরিবেশর ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশের রয়েছে মোট আয়তনের ১৭ দশমিক ৪ ভাগ; যা প্রয়োজনে তুলনায় অপ্রতুল। যা আছে তা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ফুসফুসের মতো। কিন্তু ভূমি দস্যুদের কারণে মাইলের পর মাইল পাহাড় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কেটে তৈরি করে করা হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসী বায়ুদূষক ইটভাটা। অসাধু ব্যবসায়ীরা নিবির্চারে গাছ কেটে রাষ্ট্রীয় সম্পদ পাচার করে দিচ্ছে।

পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সচেতন সকল নাগরিকদের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। শুধু প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দিবস পালন করা মানেই পরিবেশ রক্ষা নয়। সারা বছর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে যেতে হবে। ‘গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে আরো সম্প্রসারণ করতে হবে।

একটি বৃক্ষ মানেই একজন মানুষের জীবন। রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহার কমাতে হবে। মাটি দূষণকারী প্লাস্টিকসহ অপচনশীল পণ্যে বর্জন করে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার করতে হবে। অসাধু ব্যক্তি, যারা পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এ অবস্থায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে রাজধানীর গাছ রক্ষার মাধ্যমে বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দারা। রাজধানী ঢাকার ক্রমবর্ধমান বৈরী পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে গাছ রক্ষার বিকল্প নেই।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, নগরের অস্তিত্বের সঙ্গে গাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নগরীর সবুজ এলাকার তাপমাত্রা ও বাণিজ্যিক এলাকার তাপমাত্রার পার্থক্য আমরা বিভিন্ন গবেষণায় জেনেছি। ফলে প্রকল্প নির্ভর উন্নয়নের নামে সবুজ উজাড়ের ফলাফল হবে ভয়াবহ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নগরবাসীর প্রয়োজনেই গাছ রক্ষা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে নগরীয় গাছ রক্ষা ও সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প বাজি ও উন্নয়নের নামে গাছকাটা যাবে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গরমে চারদিকে হাঁসফাঁস অবস্থা। ঢাকাসহ দেশের সর্বত্রে প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। নদী-নালা শুকিয়ে গেছে। নলকূপে পানি উঠছে না। সেই মুহূর্তেও গাছ কেটে উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। কোন এলাকায় কী ধরনের উন্নয়ন হবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণের আওয়াজ তুলতে হবে। উন্নয়নের নামে গাছ কাটার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এলাকার পরিবেশ রক্ষায় বিপুল পরিমাণে গাছ লাগানো হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত