ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য

আওয়ামী লীগেও বিতর্কিত হলেন জিএম কাদের

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ ছিল
আওয়ামী লীগেও বিতর্কিত হলেন জিএম কাদের

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করে আবারও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে বিতর্কিত হলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। সাম্প্রতি তিনি সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বক্তব্যে দিয়েছেন, তা নিয়ে সব মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অন্যদিকে ভাবি রওশন এরশাদ নিজের দল গোছানোর কাছে ব্যস্ত রয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ ভোটের পর থেকে একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছেন জিএম কাদের। অন্যদিকে রওশন এরশাদ পন্থিরা হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে সরকারের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য সরকারে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ ছিল জিএম কাদেরের এমন বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কে কাকে হুমকি দিয়েছে? তাদের জন্ম তো বন্দুকের নলে। তারা গণতন্ত্রের মধ্যদিয়ে আসেনি। গত নির্বাচনে বাংলাদেশের ৪২ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে। ভোটের দিন কোনো খুন-খারাবি হয়নি। এখানে আমরা কোনো চাপ অনুভব করিনি। তিনি কোন কারণে, কার চাপে নির্বাচনে এসেছেন, সেটা জিএম কাদেরকে পরিষ্কার করতে হবে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, পাকিস্তান আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে পায়। পাকিস্তান একসময় বোঝা ভাবত, এখন লজ্জিত। এতে রিজভীদেরই লজ্জা পাওয়া উচিত।

এর আগে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভায় জিএম কাদের বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য জাতীয় পার্টির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ ছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, দেশে তার ‘ওয়ান পার্টি রুল’ চলছে। এতে করে রাজনৈতিক শূন্যতা ও চরমপন্থার সৃষ্টি হতে পারে। জিএম কাদের তার বক্তব্যে বিগত নির্বাচনের বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতি প্রশ্ন করেন- ‘পচা, মরা ও আবর্জনা নিয়ে বিরোধীদল তৈরি করতে চেষ্টা করছে। আর আওয়ামী লীগের গৃহপালিত মিত্রদের কী অবস্থা?’

নির্বাচন থেকে সরে আসার বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, দ্বাদশ নির্বাচনে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন চাপ এসেছিল। ১৭ ডিসেম্বর (২০২৩) আমি নির্বাচন থেকে সরে আসার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তারপর চাপ এলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ চাপের কথা আমি বিস্তারিত বলব না, আপনারা বুঝে নেবেন। পরোক্ষ চাপ হলো যদি আমি নির্বাচনে না যাই, তাহলেও নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার এবং আমার সঙ্গে যারা থাকবেন তাদের নেতৃত্বে নয়, অন্যদের দিয়ে নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাতে বুঝলাম, জাতীয় পার্টি গৃহপালিত দল হিসেবে নির্বাচন করে রাজনৈতিক মাঠ থেকে হারিয়ে যাবে। আমরা রাজনৈতিক মঞ্চ হারাব, তাতে ভবিষ্যতে আমরা দেশ ও জাতির জন্য কিছুই করতে পারব না।

তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম, আমাদের নিশ্চিত করুন নির্বাচন হবে সুষ্ঠু ও নিরেপেক্ষ। প্রশাসন দলীয় কর্মীদের মতো আচরণ করবে না। তারা কথা দিলেন তারা সেটা করবেন। এটা করতে গিয়ে তারা আমার স্ত্রীর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সরিয়ে নিয়ে বললেন, বাকিগুলো প্রসেসে আছে। বাইরে প্রচার করলেন, আমি স্ত্রীর মনোনয়নের জন্য দলকে বিক্রি করে নির্বাচনে এসেছি। জাপা চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা না গেলেও নির্বাচন হতো, জাতীয় পার্টি সেখানে যেত। সরকারের সেরকম প্রস্তুতি নেওয়া ছিল।

তিন পররাষ্ট্র শক্তি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য জীবন-মরণ সংগ্রাম ছিল। যেকোনো মূল্যে তাদের নির্বাচনে যেতেই হবে, তা না হলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কিছু না কিছু বলেছিল। তা থেকে আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি- অন্তত তিনটি বড় পরশক্তি এই নির্বাচনকে সফল করার জন্য সমর্থন জানিয়েছে। পরবর্তীকালে সরকারকেও তারা চালিয়ে নিয়ে যেতে চান। এছাড়া আরো কয়েকটি দেশ এই নির্বাচনে সরকারকে সমর্থন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কেন না, এসব পররাষ্ট্র শক্তির নিজস্ব স্বার্থ জড়িত ছিল।

ভোটের দর কষাকষির সুযোগ নিয়ে জিএম কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টির দর কষাকষির সুযোগ থাকত। তবে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আওয়ামী লীগ আগ্রহী ছিল না এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আগ্রহী ছিল না।

তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল- বিএনপি, আমরা ও আওয়ামী লীগ একসঙ্গে নির্বাচন করলে দর কষাকষির সুযোগ হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষই চাইবে, আমাদের সরিয়ে নিয়ে আসতে। ফলে আমরা সেখানে একটা রাজনৈতিক মূল্য পাব। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, বিএনপি আন্দোলনের কয়েকটি ফাঁদে পড়ে গেল। এটা তাদের দোষ দিচ্ছি না। আন্দোলন করলে কিছু সহিংসতা হয়, বাইরে থেকে এসব সহিংসতা তৈরি করা হয়। কাজেই এই সহিংসতার নাম করে তাদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করা হলো। তাদের সাজা দেওয়া হলো পুরোনো মামলায়। বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা হলো। ফলে মাঠে থাকলাম আমরা। তখন মাঠে থাকলাম আমরা আর আওয়ামী লীগ।

সংসদে বিরোধী দলের নেতা বলেন, বুঝলাম, আমরা না থাকলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। এটা নিয়ে আমরা উৎফুল্ল ছিলাম, যদি নির্বাচনে যাই হয়তো ভালো কিছু সুফল পেতে পারি। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরও আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে আসেনি। একটা পরিষ্কার বিষয় বোঝা গেল তারা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার জন্য এতটা লালায়িত ছিল না। তাদের এমন ভাব ছিল আমাদের প্রতি যে, নিলে নেও না নিলে নাই।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘প্রশাসনের ভূমিকা ও অর্থের অভাবে আমাদের অনেক জনপ্রিয় নেতা নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছে প্রশাসন।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর অনেক সহকর্মী ভুল বুঝে দূরে সরে গেছেন, ভালো থাকলে দুঃখ নেই। কিন্তু যারা প্রার্থী হলেন না, নির্বাচন করলেন না, তারা গেলেন কেন? পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিনিধিত্ব করেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তার নেতৃত্বেই জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে।

এদিকে আধা কিলোমিটারের কম দূরত্বে গত শনিবার জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের ডাকা দুই সভা হওয়ার কথা ছিল। এ নিয়ে দুই পক্ষের উত্তেজনাও ছিল। তাপপ্রবাহের কারণ দেখিয়ে রওশনপন্থি জাতীয় পার্টি (জাপা) সভা স্থগিত করেছে। তবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা করে। রওশনপন্থি জাপার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ জানান, সভাটি স্থগিত করা হয়েছিল। এর পরিবর্তে ঢাকার ১০টি পয়েন্টে তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ জনসাধারণের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ করা হয়। এই তীব্র তাপপ্রবাহে জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করা তামাশার শামিল।

জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জামানা থেকেই জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব চলছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে তা চরমে পৌঁছে। রওশনপন্থিদের মনোনয়ন দেননি জিএম কাদের। এতে ক্ষিপ্ত রওশন নির্বাচন বর্জন করেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র ১১ আসন পায় লাঙ্গল। দলটির দুই কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ কয়েক সিনিয়র নেতা দল ছেড়ে রওশনের পক্ষ নেন। গত ২৯ জানুয়ারি নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন রওশন। গত ৯ মার্চ তার অনুসারীদের সম্মেলনে তিনি একই পদে নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ষষ্ঠবারের মতো ভাঙে জাপা। গত ২০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কমিটির ৮১ সদস্যের নাম ঘোষণা করেন রওশন। তাদের কয়েকজন জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার নেতা। পাল্টা হিসেবে জিএম কাদের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা ডেকেছিল। তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেছেন, যাদের নাম ঘোষণা করেছে তারা জাতীয় পার্টিতেই রয়েছেন। এসব বিষয়ে জাপার (রওশন) সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, আমরাই মূল স্রোত। অচিরেই বুঝতে পারবেন লাঙ্গল কার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত