তীব্র গরম

আয় কমেছে শ্রমজীবীদের

প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র গরমে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। অতিরিক্ত গরমে দৈনন্দিন কাজে বের হতে পারছেন না। আবার যেসব শ্রমিক জীবিকার তাগিদে মাঠে কাজ করছেন, তারাও কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাদের জীবনের এই হাসফাঁসের মাঝেই আজ পালিত হচ্ছে শ্রমিক দিবস। দিসবটি উপলক্ষ্যে বন্ধ থাকছে সরকারি-বেসরকারি কলকারখানা।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, কয়েক দিন ধরে দেশজুড়ে দিনের তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির মধ্যে বিরাজ করছে। মাঝেমধ্যে দেশের কোথাও বৃষ্টির দেখা মিললেও গরমের তাপমাত্রা খুব একটা ওঠাণ্ডনামা করেনি। চলমান তীব্র গরমে নাকাল শ্রমিকরা।

সরেজমিন ফার্মগেট, নিউমার্কেট, কারওয়ান, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র তাপদাহে খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ পড়ছেন চরম বিপাকে। অসহ্য গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সড়কে মানুষের উপস্থিতি কম। অনেকেই পূর্ণ সময়ের বদলে ঘণ্টা চুক্তিতে কাজ করছেন।

শ্রমিকদের কেউ কেউ প্রত্যুষে কয়েক ঘণ্টা শ্রম দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই বিরাজ করছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে ধান কাটার শ্রমিক নিয়ে। কারণ ধানের জমিতে অতিরিক্ত গরম থাকায় শ্রমিকরা কাজে যেতে চাচ্ছেন না। মালিকপক্ষ বা গৃহস্থদের ভাষ্য, বেশি টাকা দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের উত্তাপ সইতে না পেরে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন শ্রমিকরা। তাদের ভয়, হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন।

টানা তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমের সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষের ভোগান্তি আর কষ্ট বেড়েছে। তীব্র রোদে রিকশাচালক ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে পারছেন না। এদিকে কাজ না করলে খাবার জুটবে না। তাই পেটের তাড়নায় প্রচণ্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বেরিয়েছেন অনেকে। গরম উপেক্ষা করে বের হলেও অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন।

গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তীব্র গরমে নাজেহাল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দেখা মিলেছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও কর্মজীবীদের জীবন যেন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তারপরও জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘাম ঝরিয়ে ছুটতে হচ্ছে তাদের। কেউবা কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন ছায়ার নিচে। গরমের কারণে দীর্ঘসময় কাজ করতে না পারায় কমে গেছে তাদের আয়ের পরিমাণও। গরমে কষ্ট কয়েকগুণ বাড়লেও আয় বাড়েনি।

কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজার সড়কে অপেক্ষা করছিলেন দিনমজুর জাহিদ হোসেন ও শফিকুল ইসলাম। তাদের সঙ্গে টুকরি-কোদাল। তারা জানান, অনেক জায়গায় শত শত দিনমজুর কাজের সন্ধানে ভোর থেকেই অপেক্ষা করেন। কিন্তু গত সাত থেকে আট দিন ধরে অনেকেই আসছেন না।

আবাসন ও নির্মাণ সংস্থার কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন জানান, তীব্র গরমের আগে সড়কের পাশে দিনমজুর পাওয়া যেত। এখন তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আগে প্রতিদিন ভোরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শত শত শ্রমিক অপেক্ষা করত, কখন ঠিকাদারের লোক আসবে। এখন আসছে হাতেগোনা কয়েকজন। শ্রমিক সংকটে নির্মাণের অনেক কাজ আটকে গেছে।

যাত্রাবাড়ী কয়েকজন বাসচালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, গরমের কারণে মানুষ বাসা থেকে কম বের হচ্ছে, যার কারণে বেশির ভাগ বাসেই যাত্রী সংখ্যা হাতে গোনা। সকালের দিকে কিছু যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। সন্ধ্যার পরও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দিনের বেলা যাত্রীদের দেখা মিলছে না। খুব প্রয়োজন ছাড়া এই গরমে মানুষ বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না, যার প্রভাব পড়ছে গণপরিবহণেও।

শনিরআখড়া সড়কে হেঁটে হেঁটে মাছ বিক্রি করছেন সোলেমান সরকার। তিনি বলেন, তীব্র গরমে কয়েক দিন মাছ বিক্রি করতে সড়কে বের হয়নি। কিন্তু আজকে পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে মাছ বিক্রি করতে নেমেছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা মাঝারি থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ থাকবে আরো কয়েক দিন। গতকাল দেশের ১৫ অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। দুপুর ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এছাড়া যশোর ও রাজশাহীতে তাপমাত্রা ছিলো ৪২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

ঊর্ধ্বমুখী তাপমাত্রায় বেশিক্ষণ বাইরে কাজ করা যাচ্ছে না। সুযোগ পেলেই ছায়া খুঁজে নিচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষরা। অনেকে প্রাণ জুড়াচ্ছেন নদীর কাছাকাছি গিয়ে।

ময়মনসিংহেও গরমে দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। গরম থেকে স্বস্তি পেতে অনেকে ভিড় করছেন শরবত ও জুসের দোকানে। বরিশালের গ্রামগুলোতে গরমের পাশাপাশি ঘনঘন লোডশেডিং বাড়িয়েছে দুর্ভোগ। এছাড়া দিনের বেলা রাস্তায় লোক কমে যাওয়ায় কমে গেছে রিকশাচালকদের আয়। নোয়াখালীতে বিশেষ কাজ ছাড়া বিকাল পর্যন্ত কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। যারা বের হচ্ছেন, গরমে স্বস্তি পেতে ছুটছেন শরবতের দোকানগুলোতে।

জামালপুরে গরমের পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে বাড়িয়েছে ভোগান্তি। সড়কে বের হয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মেহেরপুরে তীব্র তাপ প্রবাহ চলতে থাকায় বোরো ধান খেত শুকিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত সেচ দিয়েও খেতে পানি ধরে রাখতে পারছেন না কৃষকরা। এতে পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ নিয়েও শঙ্কায় কৃষক। তীব্র গরমে ছন্দপতন ঘটেছে শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। জীবিকার তাগিদে প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করেও তারা ঘর থেকে বাইরে বেরোচ্ছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘসময় কাজ করতে না পারায় এবং রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কম থাকায় ভাটা পড়েছে তাদের আয়ে।

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সূর্যের প্রচণ্ড তাপে নাজেহাল অবস্থায়য় রিকশাচালক, পথচারী, হকার, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা বাইরে আছেন। রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় গামছা ও মাথাল ব্যবহার করছেন তারা। আবার গরমে হাঁপিয়ে ওঠা অনেকে ক্লান্তি দূর করতে সড়কের পাশে ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে শরবত পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন।

শহরের শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সার সড়কে এক রিকশাচালক বলেন, গরমে ঠিকমতো রিকশা চালানো যায় না। আবার রাস্তায় যাত্রীও অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম। গত কয়েক দিন মালিকের জমা টাকা দিতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

হারুন নামে আরেক রিকশাচালক বলেন, সকালে কিছু সময় রিকশা চালিয়ে বিকালের আগে আর বের হতে পারি না। এত গরমে ঘরেও শান্তি নেই। সারা দিনে অল্প কিছুক্ষণের জন্য ঘরে ফিরলেও লোডশেডিং। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী তিনি বলেন, আগে এরকম গরম দেখিনি। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। কতক্ষণ হাঁটার পরপরই বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। গরমে দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় কমে গেছে।

শ্রমিক আবুল খায়ের বলেন, গরমে আয় একেবারে কমে গেছে। আগে দৈনিক ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হতো। গত কয়েক দিন তার অর্ধেকও আয় হয় না। খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। তারপরও সংসার তো আর গরম বুঝবে না। তাই নিরুপায় হয়ে এত গরমে বসে আছি। এদিকে চলমান দাবদাহ আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস।