ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবেশ রক্ষায় চাই সম্মিলিত লড়াই

বাড়াতে হবে বাজেট, গাছ কাটা বন্ধে নিতে হবে আইনি পদক্ষেপ : পরিবেশবিদরা
পরিবেশ রক্ষায় চাই সম্মিলিত লড়াই

পরিবেশ রক্ষায় বছরে পর বছর কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি থাকলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সড়ক প্রশস্তকরণের নামে চলছে গাছ কর্তন। এছাড়া সরকারি-ব্যক্তিমালিকানা পুকুর ও খাল ভরাট করা হচ্ছে। ফসলি জমি নষ্ট করে ইটভাটা চালান হচ্ছে। এতে দিনে দিনে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়ছে। পরিবেশবিদদের মতে, পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে মিটিং, মিছিল করলেও টনক নড়েনি কারও। ফলে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা প্রাণিকূলে। সেজন্য পরিবেশ রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জোরালো ভূমিকার দরকার।

জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জলবায়ু সংশ্লিষ্ট ২৫টি মন্ত্রণালয়-বিভাগের জাতীয় বাজেটে প্রায় ৩৭ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন ও পরিচালনে ১ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে পরিবেশ রক্ষায় আগামীতে বাজেটের পরিমাণ আরো বাড়ানো দরকার। পরিবেশবিদরা বলছেন, পরিবেশ রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে তীব্র গরমে চরম অস্বস্তিতে মানুষ। বাসা-অফিস ও বাইরে কোথাও যেন স্বস্তি নেই। এর মধ্যেই সবুজায়ন উজাড় করা হচ্ছে। দুর্বৃত্তরা পাহাড়ে গাছপালা কাটছে। বিপুল পরিমাণ কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। দিনের পর দিন পরিবেশের ওপর যেভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা অব্যাহত থাকলে আগামীতে গরমের তীব্রতা আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য সবুজায়ন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাড়ছে দেশের মানুষ, বাড়ছে বাজেট। কমছে অরণ্য, জলাভূমি, বৃক্ষ, নদী, প্রাণবৈচিত্র্য, পাহাড় কিংবা উন্মুক্ত পাবলিক প্রান্তর। পরিবেশবাদীরা পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বললেও সরকার সাধারণত তা উপেক্ষা করছে। পরিবেশ রক্ষার ওপর সরকারকে জোর দিতে হবে। গত বাজেটগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিবেশ খাতে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ কখনো কমেছে আবার কখনো বেড়েছে। বরাদ্দকৃত বাজেটে সুস্পষ্ট খাত ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ ও জীববৈচিত্র্য হ্রাস উদ্বেগজনক অবস্থায় উপনীত হওয়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব বেড়েছে। পরিবেশ রক্ষায় বরাদ্দ বাড়ছে। বিদেশি উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগের আগে দেশের পরিবেশ দেখতে চান। পরিবেশরক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে দক্ষ জনবলের ইস্যুটি গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রজাতিভিত্তিক শনাক্তকরণ, নিয়মিত মনিটরিং, জীবনচক্রের ওপর হুমকি সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা দরকার। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অঞ্চলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান করা এখন সময়ের দাবি।

জীববৈচিত্র্য বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ অবনমিত স্থলজ, অভ্যন্তরীণ জলজ, উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা (অভীষ্ট ২, লক্ষ্যমাত্রা ২); ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০ শতাংশ ভূমি, সমুদ্র, উপকূলীয় এলাকা, অভ্যন্তরীণ জলাশয় সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর ও সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ যথাক্রমে ১১ ও ১৬ শতাংশ। বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমি সন্তোষজনক হলেও সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির প্রকৃত অবস্থা ভালো নয়।

পরিবেশ রক্ষায় ১০০ দিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। এতে বন, নদী ও জলাশয় দখলমুক্ত করা, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ, পলিথিনের ব্যবহার ও পাহাড় কাটা বন্ধ করার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন অমান্যকারীদের শাস্তি বাড়ানোর পরিকল্পনাও চলছে। নতুন দায়িত্বে এসে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এসব কর্মপরিকল্পনা হাতে নেন। তবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে ৪৬ লাখ একর বনভূমির মধ্যে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর দখল হয়ে গেছে। দখলদারের সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা। দখল থেকে বাদ যায়নি নদীর দুইপাড় ও জলাশয়। থামছে না নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার। এতে তীব্র হচ্ছে নদী খালদূষণ। নির্বিচারে পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে বনের জীববৈচিত্র্য। পরিবেশের যে কোনো উপাদান বায়ু, শব্দ বা পানি দূষণে যে শুধু পরিবেশেরই ক্ষতি হয় তা নয়, এখানে জনস্বাস্থ্যেরও বিরাট ঝুঁকি রয়েছে।

গত ১৭ জানুয়ারি দেশের সার্বিক পরিবেশ ও বনের উন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহযোগিতা কামনা করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে তার অফিস কক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এডিমন গিন্টিং সাক্ষাৎ করলে পরিবেশমন্ত্রী এ সহায়তা কামনা করেন।

এডিবিকে মন্ত্রী বলেন, দেশের পরিবেশ ও বন উন্নয়নে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি দেশের পরিবেশ ও বন উন্নয়নে এডিবির মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। এছাড়া বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কার্যকর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে উদাসীন, এটা বাজেট বরাদ্দেই প্রতিফলিত। পরিবেশ সংরক্ষণে মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা, লোকবল বাড়াতে বড়সড় বরাদ্দ প্রয়োজন। কেন না, এখনও ব্যাপক হারে শিল্পায়ন হচ্ছে। কিন্তু বাজেটে যদি সঠিক বরাদ্দ না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এটা টেকসই বাজেট না।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, পরিবেশের ভেতরে অন্যান্য জিনিস এমনভাবে দেওয়া হচ্ছে, যেগুলো আসলে পরিবেশের না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা অবকাঠামো বরাদ্দকে পরিবেশে দেওয়া হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি যথাযথভাবে যেন পরিবেশের জন্য টেকসই বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, পরিবেশ সংরক্ষণে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭’ যুগোপযোগী ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া, প্রণয়ন করা হয়েছে বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২। ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় ও শিল্পঘন শহরে ১৬টি সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্র (সিএএমএস) ও ১৫টি কম্প্যাক্ট বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রের (সি-সিএএমএস) মাধ্যমে বায়ুমান পরিবীক্ষণ এবং দৈনিক ভিত্তিতে বায়ুমান সূচক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হচ্ছে। শিল্পের দূষণ নিয়ন্ত্রণে ইটিপি প্রয়োজন হয় এমন ২ হাজার ৮৯৪টি তরল বর্জ্য নির্গমনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২ হাজার ৩৮২টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করা হয়েছে। অর্জিত ইটিপি কভারেজ ৮২ দশমিক ৩১ শতাংশ। পরিবেশ সুরক্ষায় বনায়ন প্রক্রিয়ার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত