সরকারি সব দপ্তরে বাড়ছে বিদ্যুতের ব্যবহার

সচিবালয়ে পরিমিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের নির্দেশ

প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা মানুষের। আর এই চলমান গরম থেকে রেহাই পেতে সরকারি সব দপ্তরে শীতাপত নিয়ন্ত্রিত এসি ও ফ্যানের ব্যবহার বেড়েছে। তবে বিদ্যুতের ওভারলোডে ট্রিপ করার ফলে বিদ্যুৎবিভ্রাটের শঙ্কা থেকে সচিবালয়ে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সাশ্রয়ী ও পরিমিতভাবে ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তীব্র গরমে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর দিকে নজর নেই কর্মকর্তাদের।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে গরমের দিনে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ৭ মেগাওয়াটের বেশি। সচিবালয়ে ভবনগুলোতে ছোট ছোট মোট ২৮০০ এসি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া অর্থ ভবনেই সেন্টাল এসি ১২০০ টনের।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে সচিবালয়ে মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দুটি টিনশেড একতলা ভবনে দাপ্তির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গরমের প্রকোপে এসব ভবনে এসির ব্যবহার বেড়েছে। এসি, কম্পিউটারের পাশাপাশি ফ্যান, চায়ের কেটলিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার বেড়েছে। সূত্রে জানা গেছে, এতদিন মন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম সচিবরা তাদের কক্ষে এসি ও কম্পিউটার পেলেও নতুন প্রাধিকারের তালিকায় উপসচিব, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কক্ষে এসি ও কম্পিউটার ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীর দাপ্তরিক কার্যালয়ও শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা এবং তাদের কক্ষে একটি করে বৈদ্যুতিক কেটলি ব্যবহারের প্রাধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সচিবালয়ে অনেক মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো করে তাদের আওতাধীন ফ্লোরগুলোর ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছেন। এসব করতে গিয়ে তারা নিজেদের মতো করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সচিবালয়ে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে। পুরো সচিবালয়ে প্রায় ৪ হাজার টনের এসি ব্যবহার হচ্ছে। এসি, ওয়াটার হিটার, চায়ের কেটলিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার বেড়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ন্যাশনাল লোড ডিসপাচ সেন্টারের তথ্য দেখা যায়, এপ্রিলের মাঝামাঝি দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। গরম বাড়ায় চাহিদা বেড়ে সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু গ্রীষ্মে উৎপাদন করা হয় ১৩ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে গত মঙ্গলবার ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট।

বর্তমান তাপদাহে অত্যধিক গরম ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বিদ্যমান বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির (সার্কিট ব্রেকার, ক্যাবল, ট্রান্সফর্মার ইত্যাদি) স্বাভাবিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় তা ওভারলোডে ট্রিপ করার ফলে বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে। বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনে এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎবিভ্রাট প্রতিরোধের জন্য অফিস কক্ষে অপ্রয়োজনে ডেকোরেটিভ লাইট, ফ্যান, এসি, কম্পিউটারসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সাশ্রয়ী ও পরিমিতভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন- এমন একটি নির্দেশনা দিয়েছে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়।

চলমান তাপপ্রবাহে সারাদেশে নেমে এসেছে অস্থিরতা। হিটস্ট্রোকে মানুষ মরছে। এরই মধ্যে রাজধানীতে লোডশেডিং কম হলেও গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) এক পরিচালক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, বিতরণ এলাকার চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। গরমের মধ্যেও বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্রাম অঞ্চলে কোথাও কোথাও লোড শেডিংয়ের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে ফুললোডে চালাতে বলছি। কিন্তু এখানে বড় বিষয় ফাইন্যান্স। গ্যাস আমাকে নিয়মিত দিতে হবে। আমি তো পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে বসে আছি। ১৮ হাজার/১৯ হাজার পর্যন্ত আমি দিতে পারব। কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট হাতে আছে। আমার প্রধান সমস্যা হলো পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো চালু রাখা। তাদের ফাইন্যান্স সাপোর্ট দেওয়া। এটাই এখন আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার আশঙ্কা থাকছেই।

গত ২৩ এপ্রিল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞাপ্তিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস কক্ষের বাইরে অবস্থানকালে এসি, ফ্যান, লাইট ইত্যাদি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির সুইচ বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে নির্দেশনায়।

বিজ্ঞাপ্তিতে আরো বলা হয়, সারা দেশে লোডশেডিং পরিহার করতে প্রত্যেকের সর্বাত্মকভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এক্ষেত্রে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ‘আমার কক্ষের সুইচ আমি নিজেই বন্ধ করি’ মেনে চলি এবং এসি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা সেটিংস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখি, যা অত্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী (স্রেডা কর্তৃক প্রণীত সরকারি অফিস ভবনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার সম্পর্কিত সমন্বিত পইডলাইন অনুসারে)।

এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসির) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘সচিবালয় আমাদের কাছে বিশেষায়িত এলাকা। আমরা এটিকে প্রাধান্য দিই। সচিবালয়ে বিদ্যুতের চাহিদা ও ডিপিডিসির বিদ্যুৎ সরবরাহের মধ্যে খুব একটা তারতম্য নেই।

গণপূর্তকে বলা আছে- তারা যখন সচিবালয়ে এসির সংখ্যা ও বিদ্যুতের লোড বাড়াবে তখন যেন তারের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী করেন। এ ব্যাপারে ডিপিডিসির সংশ্লিষ্টরা গণপূর্তের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।

প্রসঙ্গত, গরম বাড়লে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। গত ২০২২ সালেও সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে সব মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নিরূপণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই কর্মপন্থা বাস্তবায়ন হয়নি। এবারও সচিবালয়ে পরিমিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।