ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ৩৫ বছর

কর্মশক্তির অপচয়ে স্থবিরতা বাড়বে প্রশাসনে

কর্মশক্তির অপচয়ে স্থবিরতা বাড়বে প্রশাসনে

চাকরিতে প্রবেশে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর পেরিয়ে গেলে আর সরকারি চাকরির জন্য আবেদনের কোনো সুযোগ নেই। তবে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে রাজপথে সমাবেশ করেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

দিনে দিনে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপ প্রকাশ করেছে। সেখানে চলতি মে মাসের হিসেবে বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মানে গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে বেকারত্বের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।

জনপ্রশাসনের সাবেক আমলারা বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো কোনো ক্রমেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। এতে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি প্রশাসনেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। প্রবেশের বয়স বাড়ালে চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা বাড়াতে হবে। বেকারত্বের মানুষের সংখ্যা বাড়বে। বর্তমানে কোনো চাকরির নিয়োগবিধি দিলে সেখানে এক থেকে দেড় লাখ আবেদন পড়ছে, কিন্তু চাকরিতে যোগদানের সময় ৩৫ বছর করলে সেই আবেদনের পরিমাণ দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হবে। আবার অনেক যুবক চাকরি পাওয়ার আশায় জীবনের উপযুক্ত সময়গুলো শেষ করবেন। যখন চাকরি পেলেন না তখন হতাশায় অন্যসব কাজের দিকেও মনোযোগ দিতে পারবে না। পরিবারের মধ্যে বিশৃঙ্খলার মাত্রা বেড়ে যাবে। সুতরাং চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সরকারি চাকরিতে যোগদানের বয়স ৩০ বছর রয়েছে। সেখানে আরো ৫ বছর বৃদ্ধি করা হলে ৩৫ বছরে পৌঁছাবে। আর মানুষের বয়স ৪০ পেরিয়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বয়স বাড়লে সমস্যা হবেই। তবে এখন জীবনযাত্রার ভুলত্রুটির জন্য বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন ধরনের রোগ। বিশেষত, পুরুষের বয়স ৪০-এর আশপাশে হলেই মাংসপেশি দুর্বল হওয়া স্বাভাবিক। হাই ব্লাডপ্রেশার এবং প্রস্টেটের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে খুব বেশি। মানুষের মুড সুইং হতে পারে। সেক্ষেত্রে আসতে পারে ডিপ্রেশনও। নিজের প্রতি বিশ্বাস হারানো, মন মরা হয়ে থাকা, কোনো কিছু ভালো না লাগা এবং বিষণ্ণতা। সবচেয়ে বড় রোগ হচ্ছে ডায়াবেটিস। যার ডায়াবেটিস হয়েছে তাকে সব সময় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হয়।

৩৫ বছর চাকরি করার সুযোগ পেলে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ পেতে ৪০ বছর লেগে যায়। সেখানে মাঠপর্যায়ে একজন ৪০ বছরের মানুষে কাজে পাঠানো হলে শরীরে কিছুটা ঝিমানিভাব চলে আসবে। স্বল্প সময়ের চাকরির মেয়াদে অনিয়মের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাবে।

জনপ্রশাসনমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাকরিতে বয়সসীমা নিয়ে যে সুপারিশ পাঠিয়েছে তা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করব। তিনি যে নির্দেশনা দেবেন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফরহাদ হোসেন আরো বলেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সংসদে কথা বলেছেন। তিনি এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বয়সসীমা বাড়ালে অবসরের সময় নিয়ে সমস্যা হতে পারে। এরপরও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে। ব্যবস্থা নেওয়া হবে বাস্তবতা বিবেচনা করেই।

এর আগে, গত ৩০ এপ্রিল সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ বছরে উন্নীত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে সরকারি-আধা সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর মানদ- হিসেবে অনুসরণ করা হয়। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী ৩৫ বছর করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। বিষয়টি উপলব্ধি করে ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি অনুচ্ছেদে ‘সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরিখে যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’ বলে উল্লেখ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটা থাকলে ৩২ বছর পর্যন্ত আবেদন করা যায়।

বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সরকারি চাকরির বয়স নির্ধারণ ব্রিটিশ ভারত তথা উপনিবেশিক আমল থেকে শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে তখন চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল। তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৩ বছর। এরপর যখন পাকিস্তান শাসনামল আসে, তখন এই বয়সসীমা বাড়িয়ে ২৫ বছর করা হয়। কারণ তখন ধরে নেয়া হয়েছিল যে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য যেসব যোগ্যতার দরকার হয়, তার সবকিছু অর্জন করে ২৫ বছরের মধ্যে প্রস্তুত হওয়াটা কঠিন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর এই বয়স আরো ২ বছর বাড়িয়ে ২৭ বছর করা হয়।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যুদ্ধের কারণে ধরেই নেয়া হয়েছিল শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে এক বছর হারিয়ে গেছে। আর এ কারণেই শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরিতে প্রবেশের সময় বেশি লাগবে বলে বয়স বাড়ানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা লেখাপড়ায় একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম, এক বছর তো বন্ধই ছিল সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষা। তবে বয়স বাড়ানোর সেই সময়ে বলা হয়েছিল এবং ধরেই নেয়া হয়েছিল যে, সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করলে বয়স আবার ২৫ বছরে নামিয়ে নেয়া হবে। তবে পরে আর সেটি করা হয়নি। উল্টো এই বয়সের সময়সীমায় আরো পরিবর্তন আসে ১৯৯১ সালে এইচএম এরশাদের শাসনামলে। ওই সময় নানা পক্ষের চাপের মুখে এই বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর ঠিক আছে।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, চাকরিতে প্রবেশের একটা মানসিক বয়সও রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে চাকরির ক্ষেত্রে যেমন শারীরিক সক্ষমতার বিষয় থাকে, বেসামরিক চাকরিতে সেটা না থাকলেও মানসিক সক্ষমতার বিষয়টিও জড়িত।

তিনি আরো বলেন, চাকরিতে প্রবেশের পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় পিক-আপ (গ্রহণ) করা এবং সে অনুযায়ী সার্ভিস বা সেবাদান ঠিক রাখতে হলে একটা নির্দিষ্ট বয়স দরকার হয়। এছাড়া ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার বিষয়টি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বলেও মনে করা হয়। চাকরিতে কন্ট্রিবিউট করা বা অবদান রাখতে হলেও একটা নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, সে যাতে অবদান রাখতে পারে, তার জন্যও পর্যাপ্ত সময় দরকার হয়।

৩০ বছর বয়সে কেউ এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে চাকরি শুরু করতে হলে তার বয়স অন্তত ৩৩-৩৪ বছর হয়ে যায়। ফলে তার অবদান রাখার সময়সীমা এমনিতেই কমে যায়। ২৫ বছর বয়সে একজন ঢুকলে তার পিক-আপ করার সক্ষমতা যত থাকবে, ৩৪ বছর বয়সি একজনের সেই সক্ষমতা তো আর একই হবে না, কমে আসবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই বয়স নির্ধারণ করা হয় বলে জানান সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা। চাকরিতে প্রবেশের আগেই বয়স বেশি হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে, অন্য চাকরির মতো পিছুটান তৈরি হয় যা নতুন চাকরি, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে যারা সহকর্মী হিসেবে কাজ করবেন সেখানেও বয়সের পার্থক্য খুব বেশি যাতে না হয় বা একটা নির্দিষ্ট বয়সের ধারা বজায় রাখার প্রতিও নজর দেয়া হয়। বর্তমানে যে পরিমাণ শিক্ষিত তরুণ চাকরির জন্য অপেক্ষা করে থাকে, এই বয়সসীমা আরো দুই-তিন বছর বাড়ানো হলে আরো বেশিসংখ্যক তরুণ অপেক্ষমাণ থাকবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত