রাজনৈতিক নানা বিতর্কে উপজেলা নির্বাচন

প্রথম ধাপে আজ ১৩৯ উপজেলায় ভোটগ্রহণ

প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনৈতিক নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে দেশে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ভোট গ্রহণ শুরু হল আজ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাঁচ মাস পরে হতে যাচ্ছে উপজেলার ভোট।

জাতীয় নির্বাচনের মত উপজেলার ভোটেও আসেনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা। এমন পরিস্থতিতে উপজেলার ভোটে প্রার্থীতা উন্মুক্ত রাখে আওয়ামী লীগ। এই সুযোগে এমপি-মন্ত্রীর আত্মীয়রাও ভোটে দাড়িয়ে যায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীর নিকট আত্মীয়রা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্ধিতায় নামে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীদের আত্মীয়- স্বজন নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন প্রভাবিত হতে পারে এমন আশংকা ব্যক্ত করার পর নানা সমালোচনার মুখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ দলীয় নির্দেশনায় স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীদের আত্মীয়- স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অনুরোধ জানান হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজন বলতে কারা তা নিয়েও শুরু হয় নতুন বিতর্ক। স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীদের যেসব আত্মীয়-স্বজন সারা জীবন রাজনীতি করে আসলেও সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক থাকার কারণে তিনি উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেননা এটা এক প্রকার মানবাধিকর লংঘন। এ নিয়ে সুশীল সমাজে নানা তর্ক বিতর্ক দেখা দেয়ার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীদের আত্মীয়- স্বজন বলতে স্ত্রী/ স্বামী কিংবা সন্তানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগেরর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির আত্মীয়ের পরিধি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের গুরুত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা ভাইস চেয়ারম্যানের কর্মকান্ডের আওতা স্থানীয় উপজেলা পযায়ে। তাদের কাজের আওতা উপজেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ। উপজেলার প্রতিটি কাজে তারা সম্পৃক্ত হতে পারেন। আর দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেশি ছিল। এ ছাড়া এই নির্বাচনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ না নেয়ায় আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা এই নির্বাচনে অংশ নেন। তবে বিএনপির যেসব নেতা দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তাদেরকে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। বিএনপির অনেক নেতা এ ধরণের নির্দেশনা অমান্য করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করায় তাদের বহিস্কার করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সম্পদের পরিমাণ স্থানীয় সংসদ সদস্যদের চেয়ে বেশি বলে একটি বেসরকারি সংস্থার জরীপে উঠে এসেছে। আর সে কারণে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা দিয়েছে।

এমনি প্রেক্ষাপটে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ধাপে আজ ১৩৯ উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে চলবে টানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত। উপজেলা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এই ধাপে ১৩৯ উপজেলার মধ্যে ২২টিতে ইভিএম এবং বাকিগুলোতে ব্যালটে ভোট হবে। এই ধাপে মোট ১ হাজার ৬২৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৫৬৮, ভাইস চেয়ারম্যান ৬২৪ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৩৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৮, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ করে অর্থাৎ মোট ২৮জন প্রার্থী ইতিমধ্যে বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিজয়ী হয়েছেন।

হাতিয়া, মুন্সিগঞ্জসদর, বাগেরহাট সদর, পরশুরাম ও শিবচর এই পাঁচটি উপজেলার সব পদের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বীতায় বিজয়ী হয়েছেন। অর্থাৎ এই পাঁচ উপজেলায় কোনো পদেই ভোটের প্রয়োজন পড়ছে না। এ ছাড়া পার্বত্য জেলা বান্দরবানে তিনটি উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত করেছে ইসি। ভোটের পরিবেশ শান্ত রাখতে স্বাভাবিক এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে ১৭জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৮ বা ১৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া বিশেষ এলাকায় সাধারণ কেন্দ্রে ১৯জন ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ বা ২১ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। উপজেলার আয়তন, ভোটার সংখ্যা ও ভোটকেন্দ্রের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতি উপজেলায় ২ থেকে ৪ প্লাটুন বিজিবি দায়িত্ব পালন করবেন। উপকূলীয় এলাকার দ্বীপাঞ্চলে কোস্টগার্ড, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। ভোট কেন্দ্রে আনসার ব্যাটালিয়ন মোবাইল/স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ভোট গ্রহণের দুইদিন আগে থেকেই মোতায়েন করা হয়েছে। আগামী দুই দিন তারা নিয়োজিত থাকবে। গত রাত ১২টা থেকে আজ ভোট গ্রহণের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ট্রাক, লঞ্চ, ইঞ্জিন চালিত বোটসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ রয়েছে এবং আগামীকাল মধ্যরাত পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

ভোট গ্রহণের সাত দিন আগে ও ভোট গ্রহণের পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত লাইসেন্সধারীরা অস্ত্রসহ চলাচল না করতে কিংবা বহন ও প্রদর্শন না করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে নির্দেশনা জারি করেছে।

তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের তিন দিন পূর্ব পর্যন্ত আচরণ বিধি প্রতিপালন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষ ও প্রতিরোধে প্রতি উপজেলায় একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট এবং ভোট গ্রহণের তিনদিন পূর্ব থেকে ভোট গ্রহণের পরের দিন পর্যন্ত প্রতি তিন ইউনিয়নের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া ভোট গ্রহণের দুইদিন পূর্ব থেকে ভোট গ্রহণের দুইদিন পর পর্যন্ত প্রতি উপজেলায় একজন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত থাকবেন।

প্রথম ধাপে ১১ হাজার ৫৫০ কেন্দ্রের ৮১ হাজার ৮০০ ভোট কক্ষে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৭০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

উপজেলা পরিষদের নিবাচনের ভোট গ্রহণের আগের দিন গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে উপজেলা নির্বাচনের ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। নির্বাচন যাতে প্রভাবিত না হয় সে ব্যাপারে কমিশনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে নিজ কার্যালয়ের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। সিইসি বলেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে সেটাই বড় কথা। কোনো দল এলো কি এলো না, সেটা বড় কথা নয়। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে এ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। নির্বাচন যাতে প্রভাবিত না হয় সে ব্যাপারে কমিশন চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ভোটে কেউ যাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে ব্যাপারে ইসির অবস্থান স্পষ্ট। প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা। ভোটকেন্দ্রে অনুপ্রবেশকারীরা যাতে ঢুকতে না পারে সে ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ইসি কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। উৎসাহ-উদ্দীপনা থেকে ভোটের মাঠে যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশনা রয়েছে কমিশনের। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ভোটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথভাবে মোতায়েন করা সম্ভব হবে। প্রার্থী ও প্রার্থীদের কর্মীদের নির্বাচনে সহযোগিতার আহ্বান জানান ?তিনি। গণমাধ্যমের মাধ্যমেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের চিত্র দেখা গেলে কমিশন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান সিইসি। প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট হবে। প্রথম ধাপে পাঁচটি উপজেলার প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছে বলে জানান সিইসি। এদিকে দলীয় সিদ্বান্ত অমান্য করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ মিলিয়ে অন্তত ১৩৯ জনকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।

বিগত কয়েক বছর ধরে টানা আন্দোলন, জেল-জুলুম ভোগ করার পর তৃণমূলের নেতাকর্মীরা উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দেখান। অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার পর দলের তরফে পুরস্কার হিসেবে ‘বহিষ্কার’কে দেখছেন তারা। বিশেষ করে সরাসরি বহিষ্কারের কারণে তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের অভিমত ‘বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে তৃণমূলে সাংগঠনিক বিরোধের স্থায়ীকরণ করা হলো। এর ফল দলকেই ভুগতে হবে।

দলীয় সূত্র বলছে, তৃতীয় ধাপে নির্বাচনে বিএনপির তৃণমূলের অংশগ্রহণ বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে বহিষ্কারের তালিকা আরও দীর্ঘ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে করে তৃণমূলে বিএনপির সাংগঠনিক পরিস্থিতি দুর্বল হতে পারে। তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জানিয়েছেন ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার জন্য দলের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত রয়েছে। যারা অংশগ্রহণ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যাতে দলের শৃঙ্খলা অক্ষুন্ন থাকে।’ তবে একাধিক সাংগঠনিক সম্পাদক মনে করছেন, ‘বহিষ্কারের কারণে তৃণমূলে বিরোধ, বিবাদ দুটোই বাড়বে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তৃণমূল স্তরে বিভক্ত। এর রেশ এখন বিএনপিতে ছড়িয়ে পড়বে। স্থানীয় রাজনীতিতে মেরুকরণ ঘটবে।’ বিএনপির কেন্দ্র থেকে উপজেলা নির্বাচন বয়কটে দেশব্যাপী লিফলেট প্রচারণা চলছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ এ ইস্যুতে বক্তব্য দিচ্ছেন।