ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দুর্ঘটনা কমাতে গাড়ির গতিসীমা নির্ধারণ

উল্টোপথে সড়ক বিভাগ

উল্টোপথে সড়ক বিভাগ

বিশ্বের অনেক দেশে সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির গতি বাড়ালেও উল্টোপথে চলছে বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে গাড়ির গতি বেঁধে দিয়েছে সংস্থাটি। এতে যাতাযাত ব্যবস্থায় সময় বেশি লাগার পাশাপাশি গাড়িচালকদের নিয়মভাঙার প্রবণতা বাড়বে বলে মনে করছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, দেশে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গতি কমিয়ে আনতে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। নতুন নীতিমালায় দেশের এক্সপ্রেসওয়ে, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার। আর নগর-মহানগরে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সুপারিশে এ নীতিমালা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘গাড়ির গতি কমিয়ে শহর এলাকায় দুর্ঘটনা কমানো গেলেও এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতি কমিয়ে কখনো দুর্ঘটনা কমানো যায় না। এটি হচ্ছে বিজ্ঞান। দ্রুত গতির সড়ক অনেক টাকা খরচ করে করা হয়, যাতে দ্রুত গতিতে অর্থনীতির চাকাটা ঘুরানো যায়। সেই জায়গায় আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে সড়ক-মহাসড়ক করছি, সেখানে গাড়ির গতি কমানো বিজ্ঞান সম্মত নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘শহর ও আবাসিক এলাকায় গাড়ির গতি বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। মহাসড়কে গাড়ির গতি নির্ধারণে ভিন্ন ভিন্ন লেন তৈরি করা যেতে পারে। সেখানে হাইওয়ে পুলিশ নীরব নজরদারি করবে, যাতে সীমিত গতির গাড়ি দ্রুত গতির লেনে যেতে না পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সড়কে গাড়ির গতি ১২০ কিলোমিটার। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেও সড়কে গাড়ির গতি ১১০ কিলোমিটার। দুর্ঘটনা গতির জন্য হয় না, গতির পার্থক্যের জন্য হয়।’

বিআরটিএ’র রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেছেন, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, মোটরসাইকেল ৬০ কিলোমিটার এবং ট্রাক চলবে ৫০ কিলোমিটার গতিতে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা শহরের মধ্যে মোটরসাইকেল ও ট্রাক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। অন্যান্য যানবাহনের জন্য এ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। যদি কেউ গতিসীমা লঙ্ঘন করে তার বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন অমান্যকারীকে তিন মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে। এক্সপ্রেসওয়ে ও মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে না।

বিআরটির চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর আওতায় বিআরটিএ এ বিধিমালা তৈরি করেছে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)।

নতুন নীতি অনুযায়ী, জাতীয় মহাসড়কে (ক্যাটাগরি এ) প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, বাস ও মিনিবাসসহ অন্যান্য হালকা যানবাহন সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে এবং ট্রাক, বাইক এবং আর্টিকুলেটেড লরির জন্য সীমা হবে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার। জাতীয় সড়কে (ক্যাটাগরি বি) গাড়ি, বাস ও মিনিবাসের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার, বাইকের জন্য ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির জন্য ৪৫ কিলোমিটার। জেলা সড়কে গাড়ি, বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার, বাইক ৫০ কিলোমিটার এবং ট্রাক ও আর্টিকুলেটেড লরির ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার গতি নির্ধারণ করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও জেলা শহরের ভেতরের রাস্তায় গাড়ি, বাস ও মিনিবাসের গতিসীমা হবে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার এবং ট্রাক, মোটরসাইকেল ও আর্টিকুলেটেড লরিতে গতিসীমা থাকবে ৩০ কিলোমিটার।

গাইডলাইনে উপজেলা ও গ্রামের রাস্তার গতিসীমাও নির্ধারণ করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার ও আবাসিক এলাকার কাছাকাছি গতিসীমা নির্ধারণ করে দেবে। তবে জাতীয় সড়কে ৪০ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়কে ৩০ কিলোমিটারের বেশি হবে না। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এ নিয়ম অ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার সার্ভিসের মতো জরুরি পরিষেবা দেওয়া যানবাহনের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলেছে, দেশব্যাপী উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির ফলে সড়ক ও মহাসড়কে দ্রুতগতির যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রায়ই অনাকাঙ্ক্ষিত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ মোটরযানের অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়াভাবে মোটরযান চালানো। দ্রুতগতির কারণে আঘাতের মাত্রাও হয় অত্যধিক। ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যেই নতুন এই নির্দেশিকা জারি করা হলো বলে জানানো হয়।

গতিরোধকে নির্দেশকের বালাই নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধিকাংশ সড়কে, বিশেষ করে গলিতে। ডিএসসিসিতে গতিরোধকের সংখ্যা প্রায় ১৭৫ বলে জানায় সংস্থার যান্ত্রিক বিভাগ। অন্যদিকে, ডিএনসিসির কাছে গতিরোধকের কোনো হিসাব নেই। গতিরোধক সাধারণত দুই ধরনের। ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওতাধীন হানিফ ফ্লাইওভারে গাড়ির গতি নির্ধারণ করা থাকলেও অধিকাংশ গাড়িচালক সেটি মানছে না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, ছোট যানবাহন ক্রমশ বৃদ্ধি, বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সার্ভিস লেন না থাকায় ইজিবাইক, রিকশা, অটোরিকশা বিভিন্ন ফিডার সড়ক থেকে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে নেমে আসার ফলে এসব ছোট যানবাহন দূরপাল্লার বাস ও প্রাইভেট কারের গতি কমিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া, গুরুত্বপূর্ণ জংশন, রাস্তার মোড় ও বাস স্টপেজগুলোয় যানজট তৈরি করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত