কাপ্তাই-পতেঙ্গা রুটে নামছে এসি বাস

প্রকাশ : ০৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে গণপরিবহনে যাতায়াত খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যকর নয় নগরবাসীর জন্য। নগরীতে যেমন ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্ম্য বেড়েছে, তেমনি ট্রাফিক সিগন্যাল না মানায় বেড়েছে যানজট। প্রায় সব রুটেই লক্করঝক্কর বাসের ভিড়ভাট্টা। এবার লক্করঝক্কর বাসের দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে যাচ্ছেন কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে পতেঙ্গা সৈকত পর্যন্ত ১৪ নম্বর রুটের যাত্রীরা। ওই পথে নামছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস। এরই মধ্যে ১৩টি বাস প্রস্তুত করা হয়েছে রাস্তায় নামানোর জন্য। চলতি মাসের শেষ দিকে রাস্তায় নামবে এসব বাস। যেখানে সর্বনিম্ন ভাড়া ধরা হয়েছে ২০ টাকা, সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য থাকছে বিশেষ ছাড়।

‘চট্টলা চাকা’ ব্যানারে বাসগুলো চলবে শান্তি পরিবহন লিমিটেডের অধীনে। বাসগুলোর চ্যাসিস ভারতীয় টাটা কোম্পানির এবং বডি তৈরি দেশে। বাসের আসন সংখ্যা ৩৮টি। কাউন্টারভিত্তিক সার্ভিস হওয়ায় আসনের অতিরিক্ত যাত্রী ওঠার সুযোগ থাকবে না বাসটিতে। ট্রাফিক পুলিশ বলেছে, কোম্পানিভিত্তিক কাউন্টার সার্ভিস বাড়লে যাত্রীদের সেবার মানও বাড়বে। ঢাকার আদলেই বন্দরনগরীতে চালু হবে এ সার্ভিস। এ উদ্যোগে শতভাগ সুফল আসতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে তুলনামূলক ভালো সার্ভিস পাবে যাত্রীরা। এ বিষয়ে শান্তি এক্সপ্রেস (প্রাঃ) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান জানান, আমাদের ২০টি বাসের মধ্যে ১৩টি বাস শিগগিরই রাস্তায় নামবে। রোজার ঈদের পরেই এ সার্ভিস চালু করার কথা ছিল।

ডলার সংকটের কারণে খানেকটা দেরি হয়েছে। এসি বাস হওয়ায় আমাদের কাউন্টার একটু কম হবে শুরুতে। কাউন্টারগুলো যাত্রীর চাপ অনুযায়ী হলুদ এবং লাল- ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেওয়া হবে। ভাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সব পর্যায়ের যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে আমরা সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা সর্বোচ্চ ১০০ টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শিগগিরই ভাড়ার চার্ট অনুমোদনের জন্য বিআরটিএ’তে পাঠানো হবে। নন এসি বাস এবং রাজধানীতে চলাচল করা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য বাসের সাথে সমন্বয় করেই এই বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। আমাদের বাসে সিটের বাইরে যাত্রী নেওয়ার সুযোগ নেই। যাত্রীরা নিরাপদে-নির্বিঘ্নে এই বাসে আরোহন করতে পারবেন।

শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে হাফ ভাড়া নেওয়ার প্রজ্ঞাপন না থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের জন্য কার্ড সিস্টেম করা হবে। ওই কার্ড দিয়ে যাতায়াত করলে তারা নির্দিষ্ট পরিমাণে ভাড়া ছাড় পাবে।

চট্টগ্রাম শহরে পায়ে চালিত রিকশার কারণে বেশি যানজট হচ্ছে। নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ মোড়ে যদি এসব রিকশা তুলে দেওয়া হয় তবে যানজট অনেকটাই কমে আসবে। তখন মানুষ গণপরিবহণমুখী হবে। এটা আমাদের একটি দাবি। আর ট্রাফিক সিস্টেমকেও আরো আধুনিক করতে হবে। এদিকে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, নগরীর গণপরিবহন সেবা নিয়ে ৫৪ শতাংশ মানুষ অসন্তুষ্ট। এছাড়া প্রায় ৬৬ শতাংশ নগরবাসী গণপরিবহনে যাতায়াতকালীন সময়ে অসুবিধা বোধ করেন এবং ৬৯ শতাংশ মনে করেন নগরের গণপরিবহন সেবা তাদের জন্য অনিরাপদ। চট্টগ্রাম নগরীর গণপরিবহন ব্যবহারকারী যাত্রীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা নিরূপণবিষয়ক গবেষণা’য় এ তথ্য উঠে আসে। বেসরকারি সংস্থা ইপসা এ গবেষণা পরিচালনা করে। গতকাল এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গণপরিবহণ ব্যবহারকারীরা তাদের অসন্তুষ্টির জন্য অতিরিক্ত ভিড়, যানজট, যানবাহনের স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত পরিষেবা, যানবাহনের দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিবন্ধী ও প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য কোনো সুবিধা না থাকা, নিরাপত্তার অভাব এবং উচ্চ ভাড়াকে দায়ী করেন। গবেষণায় ওঠে আসে, ভিড়ের সময় পরিবহন চালকরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রবীণ ব্যক্তি, নারী, গর্ভবতী নারী বা শিশুদেরকে গাড়িতে তুলতে চান না। এছাড়া গণপরিবহন পরিষেবাগুলোতে প্রবীণ, গর্ভবতী নারী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত বসার জায়গা থাকা সত্ত্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সংরক্ষিত জায়গা ঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না।

৮০ শতাংশ যাত্রী মনে করেন যে, চট্টগ্রামে গণপরিবহন সেবা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রবীণ যাত্রী এবং অন্যান্য প্রান্তিকগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। এছাড়া অত্যাধিক ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে অনেক সময় যৌন হয়রানি, পকেটমার ও মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ কারণে চলন্ত বাস থেকে যাত্রীরা নেমে যেতে বাধ্য হন। সংশ্লিষ্টরা জানান, সকল ধরনের যাত্রী বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য গণপরিবহনসমূহে নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবাপ্রদানের চ্যালেঞ্জ এবং দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করা, গণপরিবহনসমূহে বিদ্যমান নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবাসমূহ উন্নয়নের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করা এবং নগরীর গণপরিবহন সেবার গুণগত মান উন্নয়নে নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পাবলিক সেবা প্রদানকারী স্টেকহোল্ডার সক্ষমতা নিরূপণে গবেষণাটি চালানো হয়। এতে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে ইউএনএসকেপ। গবেষণায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পরিবহন শ্রমিকদের সক্ষমতা উন্নয়ন, সড়ক পরিবহন আইন পরিচিতি এবং অনুসরণ, আসন সংখ্যা অনুসারেই যাত্রী তোলা, নারী-শিশু-প্রতিবন্ধী, প্রবীণবান্ধব পরিবহন সেবা গড়ে তোলা এবং বাস স্টপেজে ভালোভাবে থামিয়ে যাত্রী তোলা নিশ্চিত করা।

এছাড়া প্রাইভেট পরিবহন কোম্পানি গঠন, বাসভাড়ায় ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবস্থা, যাত্রী ও পরিবেশ বান্ধব আদর্শ স্টপেজ নির্মাণ করারও সুপারিশ করা হয়। এদিকে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের পাশাপাশি উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্ভাব্য করণীয় বিষয় নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থা, গবেষক, শিক্ষক ও সাংবাদিক, গণপরিবহন মালিক ও শ্রমিক, গণপরিবহন ব্যবহারকারী বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে মঙ্গলবার (৮ মে) দিনব্যাপী এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব নাজনিন ওয়ারেস। অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহীন উল ইসলাম চৌধুরী। ইপসার পরিচালক (সামাজিক উন্নয়ন) নাছিম বানুর পরিচালনায় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. রাশেদুল হাসান, সহকারী অধ্যাপক শাহজালাল মিশুক, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (উত্তর) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) কীর্তিমান চাকমা, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) আতিকুর রহমান, বিআরটিসির ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মো. জুলফিকার আলী, চট্টগ্রাম নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) ও নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী, ট্রান্সপোর্ট প্রফেশনাল এলায়েন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল হাসান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল, কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল। এছাড়া প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউএনএসকেপ’র প্রতিনিধি মদন বি রেজভি, ভারতের সিইপিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিভানন্দ সোয়ামি, নগর বিশেষজ্ঞ মো. নুরুল হাসান ও মো. শাহজাহান। কাউন্টারভিত্তিক বাসের ফলে পারমিটবিহীন বাসের আধিক্য কমে যাবে উল্লেখ করে নগর পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন টিটো বলেন, কোম্পানিভিত্তিক কাউন্টার সার্ভিস চালু হলে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং যেমন বন্ধ হবে একইসাথে যাত্রীদের সেবার মানও বাড়বে। তবে, কাউন্টার সার্ভিসের শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলতে হবে। এই উদ্যোগকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। তিনি আরো বলেন, কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিসের ফলে নগরীতে ফিটনেস এবং পারমিটবিহীন বাস চলাচল আস্তে আস্তে কমে যাবে।

এরই মধ্যে আমরা জরিপ করে অনেক বাসের পারমিট বাতিলের জন্য বিআরটিএ’তে সুপারিশও করেছি। এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন জানান, এই সেবা চলমান থাকবে কি না, সেটি প্রশ্ন। কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের ওপর নির্ভর করবে সেটি। তবে, সড়কে লক্কর-ঝক্কর বাস যেগুলো আছে, সেগুলো থেকে যাত্রীরা পরিত্রাণ পাবে। নতুন গাড়ি এলে মানুষজন অবশ্যই সুবিধা পাবে। তিনি আরো বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক বিভাগের আরো আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। দায়িত্বরতদের জবাবদিহীর আওতায় আনতে হবে। তাদের সড়ক পরিবহন আইনের প্রয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আর আইন প্রয়োগ সবার জন্য হতে হবে সমান। জানা গেছে, ২০২৩ সালের মার্চে মাসে এসি বাস সার্ভিসের অধীনে ৩০টি বাস চলাচলের অনুমতির জন্য বিভাগীয় নগর পরিবহন কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেন শান্তি এক্সপ্রেস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান মনজুর আলম চৌধুরী। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নগরের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই বাস সার্ভিস চালুর সুপারিশ করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি (আরটিসি)। এরপর চলতি বছরে মেলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অনুমতি। এর আগে ২০১৬ সালে ৬টি বাস দিয়ে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত ১৪ নম্বর রুটে এসি বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয় প্রিমিয়ার ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান। তবে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরুর আগেই উদ্যোগটি ভেস্তে যায়।