ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাসে গেটলক ও ই-টিকিটিং সিস্টেম ব্যর্থ

সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়

মানসম্মত বাস সড়কে নামাতে হবে - যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়

রাজধানীর যানজট দূর করতে গণপরিবহনে গেটলক ও ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা হলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। এতে সড়কে যানজট নিরসন ও গাড়ি শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি। তবে নতুন নিয়ম কার্যকরে কয়েক দিন জোরেসোরে অভিযান চালাতে দেখা যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ট্রাফিক পুলিশের। কিছুদিন যাওয়ার পর ওই নিয়ম মুখ থুবড়ে পড়ে। এবারও সড়কে যানজট নিরসন ও গাড়ির বিশৃঙ্খলা ফেরাতে মহাখালী, বনানী ও আব্দুল্লাপুর পর্যন্ত আন্তঃজেলা বাসের গেটলক সিস্টেম চালু করা হয়েছে। যেসব বাস গেটলক সিস্টেম অমান্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবে ট্রাফিক পুলিশ। এই রুটেও কিছুদিন পর বাসে গেটলক সিস্টেম উধাও হয়ে যাবে। সেজন্য বাস মালিক, বাসচালক, হেলপার ও ট্রাফিক পুলিশের সম্মিলত উদ্যোগ ছাড়া রাজধানীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, রাজধানীজুড়ে যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত কাজ করছে। এরপরও সড়কের বিভিন্ন স্থানে গণপরিবহন যত্রতত্রভাবে যাত্রী ওঠাণ্ডনামা করায় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিকল্পিত নগরীর মানদ- অনুযায়ী একটি শহরের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ ভাগ সড়ক থাকা জরুরি হলেও ঢাকা শহরে মাত্র ৭ ভাগ। এ প্রেক্ষাপটে রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটা প্রত্যাশিত হলেও বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এর মধ্যেও যাত্রীদের যত্রতত্র ওঠা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ।

সরেজমিন পল্টন, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী ও হানিফ ফ্লাইওভার ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর প্রায় সব সড়কেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশ্বের প্রায় সব বড় শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে খোদ রাজধানীর সিংহভাগ সিগন্যালই পুলিশের হাতের ইশারায় পরিচালিত হয় এখনো। রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত বাতি স্থাপন করা হলেও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ বাতি অকেজো হয়ে পড়ে।

বহু গণপরিবহন চালক অর্থলোভে মেতে ওঠেন বেপরোয়া প্রতিযোগিতায়। সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ির চালকরাও দায়ী। বহু পথচারী ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপারের চেষ্টা করে থাকে; অনেকে শৃঙ্খলা মানেন না। কেউই যেন সড়কের শৃঙ্খলা মানতে চায় না। রাজধানীর বিশৃঙ্খলা দূর করতে এবং যানজট কমাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

রাজধানীতে বাসে গেটলক সিস্টেম চালুর বিষয়ে গুলশান ট্রাফিক বিভাগ বলেছে, টার্মিনাল থেকে যাত্রী নিয়ে বাস গেটলক করে ছাড়া হবে, পরে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া আর কোথাও দাঁড়াতে পারবে না। টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে কাকলী, কুর্মিটোলা, খিলক্ষেত ও সর্বশেষ আবদুল্লাহপুর থেকে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে চলে যাবে। যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহাখালী থেকে বাস ছাড়ার আগে যাত্রীদের তালিকা, চালকের নাম, গাড়ির নম্বরসহ একটি প্রস্থানপত্র দেওয়া হচ্ছে। বাস কাকলীতে যাওয়ার পর পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, তালিকা অনুযায়ী যাত্রী আছে কি না।

মহাখালী বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল কালাম বলেন, মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া সব বাস বনানী পর্যন্ত যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করায় যানজট তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত হয়েছে- মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া কোনো গাড়ি বনানী পর্যন্ত কোনো যাত্রী ওঠাবে না। এর মাধ্যমে এই এলাকায় যানজট নিরসন হবে। মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, টার্মিনালের পেছনে দুই একরের বেশি সরকারি সম্পত্তি রয়েছে। সিটি করপোরেশন সেখানে বালু ভরাটের কাজ শুরু করেছে। কাজ শেষ হলে বাস রাস্তায় থাকবে না।

বাসে গেটলক চালু করায় আন্তঃনগর বাসের চালকরা জানান, গেটলক চালু করা হলে যত্রতত্র যাত্রী ওঠাণ্ডনামা বন্ধ হয়ে যাবে। রাস্তায় যানজটের কবলে পড়তে হয় পাশাপাশি প্রশাসনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এখন বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রী উঠবে। আমাদের দেখভাল করার জন্য শ্রমিক সংগঠনের লোকজন থাকবে। গেটলক সিস্টেম চালু হওয়ায় সুফল পাবেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের যাত্রীরা। তারা বলছেন এই সিস্টেম চালু হওয়ায় যাত্রাপথে ভ্রমণে কোনো অসুবিধা থাকবে না। ট্রাফিক গুলশান দক্ষিণের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এএসএম হাফিজুর রহমান জানান, গেটলক চেকিং সিস্টেম চালুর পর আইন অমান্য করে যত্রতত্র যাত্রী তোলায় ২৩টি বাসের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মহাখালী টার্মিনাল এলাকায় সাতটি, আইসিডিডিআরবি এলাকায় পাঁচটি, আমতলী এলাকায় ছয়টি, সৈনিক ক্লাব এলাকায় দুটি ও কাকলীতে তিনটি বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ প্রতিনিয়ত গেটলক সিস্টেম তদারকি করবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আব্দুল মোমেন বলেন, মহাখালী বাস টার্মিনাল একটি গুরুত্বপুর্ণ জায়গা। এখানে শ্রমিকরা আছেন, যাত্রীরা বাসে চলাচল করেন। সুতরাং সব প্রকার সংবেদনশীলতা মাথায় রেখে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়, যাতে যাত্রীরা কোনো প্রকার সমস্যায় না পড়েন। যে কারণে আমরা কখনো কঠোর হই কিংবা একটু নরমভাবে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আন্তঃনগর গেটলক সিস্টেম নগরবাসী ও যাত্রীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে পেশাদার জনবল প্রয়োজন। এ খাত অপেশাদার লোকে ছেয়ে গেছে। যারা সমস্যা তৈরি করতে পারে, কিন্তু সমাধান করার সক্ষমতা তাদের নেই এবং পেশাদারত্বও নেই। ফলে সমস্যাটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রাজধানীর বিচ্ছিন্ন কোনো এলাকায় গণপরিবহনে গেটলক সিস্টেম চালু করে সফলতা পাওয়ার সুযোগ নেই। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে- গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে গেটলক ও ই-টিকিটিং সিস্টেম চালু করা হলে সেটি সফলতার মুখ দেখেনি। কিছুদিন যাওয়ার পর আগের সিস্টেম সড়কে যত্রতত্র যাত্রী ওঠাণ্ডনা করানো হয়। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে বাসমালিক, চালক, হেলপার, বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা লাগবে।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা। এই শহরে যেকোনো গণপরিবহন নামানো হলে সেটিতে পর্যাপ্ত যাত্রী ওঠে। সরকার মানসম্মত গণপরিবহন সড়কে নামাতে পারলে যাত্রীদের সুবিধা হতো, সড়কে সহজেই শৃঙ্খলা ফিরতো। মহাখালী এলাকার বাসিন্দা সেলিম হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিদিন মহাখালী থেকে উত্তরা অফিস করতে যান। তার বাসে ২০ মিনিটের পথ ১ ঘণ্টা লেগে যায়। দিনের পর দিন মাসের পর মাস এভাবেই অফিসে যাতায়াত করেন সেলিম হোসেন। তিনি বলেন, বাসে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয়। ঢাকার যানজটের এ চিত্র সারা বছরের। তবে তা আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে যে কোনো উৎসব-পার্বণ ঘিরে। ব্যবসার প্রয়োজনে বনানী থেকে সদরঘাটে যাওয়া-আসা করতে হয় কাজল মিয়াকে। তিনি বলেন, রাস্তায় প্রচুর যানজট। বাসে থাকতে থাকতে খুব ক্লান্ত লাগে। বিরক্ত হয়ে যাই। কাজ শেষে বাসায় ফিরে পরিবারকে যে একটু সময় দেব সেটা আর হয়ে ওঠে না। যানজটে পুরো সময় চলে যায়। রাজধানীতে ছোট ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব গাড়ি সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখলে রাখছে। দক্ষ লোকবল দিয়ে যোগাযোগ খাত পরিচালনা না করাসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার যানজটের এ করুণ অবস্থা। যে হারে যানজট বাড়ছে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত