মাঠে প্রার্থীদের উত্তাপ আয়েশি অবস্থানে ইসি

প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে প্রার্থিদের মধ্যে উত্তাপ থাকলেও নির্বাচন কমিশন রয়েছে আয়েসী অবস্থানে। নির্বাচনে ভোটার বাড়ানোর ব্যাপারে তাদের মধ্যে তেমন কোনো তৎপরতা নেই। অনেকটা দায়সারা গেছের নির্বাচন করছে ইসি। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টিতে ইসি কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন আয়োজনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ইসির মধ্যে যে দায়িত্ব বোধ ছিল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তেমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। উপজেলা নির্বাচনের শুরুতে ইসির মধ্যে যে তৎপরতা ছিল এখন সেটাও নেই। নির্বাচনে ভোটার বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল যে কারণটি উল্লেখ করেছেন সেটি ছিল হাস্যকর। কেন না, তিনি সকালের বৃষ্টি ও ধানকাটার মৌসুমকে দায়ী করেছেন। ভোটাররা বৃষ্টিতে ভিজতে ভয় পান, সে কারণে ভোট কেন্দ্রে যাননি। আবার ধান কাটতে যাওয়ায় ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে ছাতা নামক প্রয়োজনীয় জিনিসটি রয়েছে এবং আগ্রহ থাকলে ভোটারা ছাতা নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতেন। আর সবাই তো আর ধান কাটতে যাননি। দেশের অর্ধেক ভোটার নারী। তারাতো ঘরেই ছিল। নারী ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে ভোটের উপস্থিতি ৩৬ ভাগের চেয়েও বেশি হতো। বিগত উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি ছিল। তখন ইসির পক্ষ থেকে ভোটারদের নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আহ?ান জানান হতো। প্রার্থী এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা চালাত। নির্বাচনি প্রচারণা চলাকালে কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে ইসি দ্রুত আমলে নিত। কিন্তু এবার উপজেলা ভোটে এসব উদ্যোগ নেই ইসির। ইসি বর্তমান অবস্থানে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজন করাই তাদের দায়িত্ব। আর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভোট করছে ইসি।

সূত্র জানায়, গত ৮ মে অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ। ভোটারদের এমন কম উপস্থিতির ব্যাপারে প্রধান কারণ হচ্ছে ‘একতরফা’ ভোট। এই নির্বাচনে রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিচ্ছে না। সে কারণে বিএনপির ভোটারা ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছে না। ভোটার বাড়ানোর তৎপরতার ক্ষেত্রে ইসির নি®ি?য়তাকে দায়ি করা হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মতো বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করছে।

উপজেলা ভোটের উত্তাপ না থাকার বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘ব্রতী’র নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুর্শিদ বলেন, এটা সহজেই অনুমেয়। প্রথম কথা হলো সব দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে যেভাবে হতো, তখন সকলে একরকমভাবে অংশগ্রহণ করত। তখন বেশ একটা ব্যাপকতা ছিল। শারমিন মুর্শিদ বলেন, ‘আমাদের জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন নানাভাবে বিতর্কিত হয়েছে। সেই কারণে উপজেলা নির্বাচনে অনীহা তৈরি হতে পারে।’ এছাড়া দলকে ভোটের মাঠে না পেয়ে সেই দলের ভোটাররাও হতাশ হতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।

ইসি সাবেক সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নির্বাচন নানা দলকে নিয়ে আসার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দায় থাকে। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইসির তেমন দায় থাকে না। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ইসি আয়োজন করে। কে নির্বাচনে আসবে, কে আসবে না; সে ক্ষেত্রে ইসির কার্যত কোনো দায় নেই।

নির্বাচন কমিশনার আলমগীর বলেছেন, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশে আমরা নির্বাচনগুলোয় দেখেছি ভোটের হার এমনই থাকে। কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের পৌর, ইউপি নির্বাচনে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। দেখা যায়, প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, নানা কারণে ৭০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছে, আবার ১৭ শতাংশ ভোটও পড়েছে। আরও তিন ধাপে ভোট রয়েছে। আগামীতে ভোটের হার বাড়বে কি না, সেটা তখনকার আবহাওয়া পরিস্থিতি, প্রার্থীদের ভূমিকা, নির্বাচনি পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন এই নির্বাচন কমিশনার।

তিনি বলেন, ‘আমরা ভোটের হার নিয়ে বলব না। আমরা চাই সামনের ধাপগুলো যেন আরো ভালো হয়। এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সরকার পরিবর্তন হবে না এ নির্বাচনে। তবে সব দল এলে ভোট পড়ার হার আরো বেশি হতো।’

আলমগীর বলেন, কমিশনের আহ?ান থাকবে সবার যেন অংশগ্রহণ থাকে। কোনো দল ভোটে আসছে বা আসছে না, সেটি রাজনৈতিক বিষয়। দেশের অনেক দল রয়েছে, সবার সক্ষমতা এক রকমও না। রাজনৈতিক দল যদি মনে করে ভোটে এলে জিততে পারবে না, সক্ষমতা তৈরি হয়নি; সেটা তাদের বিষয়। নির্বিঘে? কেন্দ্রে আসা, ভোটের পরিবেশ ভালো রাখাটাই ইসির মূল কাজ।

জানা যায়, সামনে উপজেলা ভোটের যে ধাপগুলো রয়েছে সেখানেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন আরো অনেকে। সেই ধাপ গুলো ওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের আত্মীয়দের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। মন্ত্রী-এমপির ‘আত্মীয় প্রার্থীদের’ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেও তা কার্যত হালে পানি পায়নি। প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ১৩ জন আত্মীয়-প্রার্থীর মধ্যে ১০ জন নির্বাচিতও হয়েছেন।

পরের তৃতীয় ধাপের নির্বাচনেও প্রায় একই পরিস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়রা কেন প্রার্থী বা জনপ্রতিনিধি হতে এত আগ্রহী- সেই প্রশ? সামনে এসেছে।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বা জনপ্রতিনিধি হতে চাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ (ফ্যাক্টর) কাজ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যতের ভাবনায় মন্ত্রী-এমপির পরবর্তী প্রজন্মকে নেতৃত্বে আনা বা জনপ্রতিনিধি করা, নেতৃত্বে বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার দৌঁড়ে পরিবারের লোকজনকে এগিয়ে রাখা, আগামীর নেতৃত্বের ক্ষেত্র প্রস্তত করা, তৃণমূলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, পরিবারের সদস্যদের রাজনীতির মাঠে আলোচনায় আনা, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিত্ব নিজেদের আয়ত্তে রাখা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাশ কাটিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি এবং শক্তিশালী করা, সামনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ করা এবং নেতৃত্বের বা জনপ্রতিনিধির সুযোগ-সুবিধাগুলো নিয়ন্ত্রণে বা কবজায় রাখা।

দলীয় সূত্র আরো জানায়, তাদের তালিকা অনুযায়ী, চলমান চার ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৫০ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। অন্যান্য সূত্রের হিসাবে প্রথম ধাপে ২০ মন্ত্রী-এমপির ৩০ আত্মীয়, দ্বিতীয় ধাপে ১৪ মন্ত্রী-এমপির একাধিক আত্মীয় প্রার্থী হয়েছেন এবং তৃতীয় ধাপে ১৩ মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়রাও প্রার্থী হয়েছেন বা হচ্ছেন। শেষ ধাপেও কয়েকজন রয়েছেন ভোটের দৌঁড়ে। এই তালিকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির সন্তান, ভাই, ভাগে?, জামাতা, শ্যালক, চাচা, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাইসহ অন্যদের নাম রয়েছে। এদিকে প্রথম ধাপে ১৩৯টির উপজেলায় ৮ মে ভোট হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ১৬০ উপজেলায় ২১ মে, তৃতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলায় ৫ জুন ভোট হবে।