কর্ণফুলী নদীতে দূষণরোধে হচ্ছে নেটিংয়ের ব্যবস্থা

নদী সুরক্ষায় পড়বে জাদুকরী প্রভাব

প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যর বাহক হিসেবে কর্ণফুলী নদীর নাম সবার উপরে থাকবে। এ নদী দিয়ে পণ্যবাহী ছোট বড় অনেক লাইটার জাহাজ চলাচল করে যা এ নদীকে পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত করেছে। এছাড়া নদীর আশপাশে গড়ে উঠা বসতির অধিকাংশেরই জীবিকা উপার্জনের উৎস এ নদীকেন্দ্রিক। কিন্তু বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা কমতে শুরু করেছে। কর্ণফুলী নদীর পাড় ভরাট ও দখল, ড্রেজিং মূলত এর জন্য দায়ী। এছাড়া নগরীর স্যুয়ারেজ, গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানাসহ সব খাতের কঠিন বর্জ্য খাল বেয়ে সোজা পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। ফলে একদিকে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে নদীর তলদেশ, পাড় ভরাট হয়ে প্রশস্ততা কমছে।এ অবস্থায় চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে খালগুলোর মুখে নেটিং করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটি হলে নদী সুরক্ষায় জাদুকরী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন কর্ণফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, ককসিট, প্লাস্টিক বোতল, কৌটা, পলিথিনসহ বিচিত্র সব বর্জ্যরে ছড়াছড়ি। নৌযান থেকে বের হওয়া বেশ পোড়াতেল ভাসছে। দিনের দুইবার করে জোয়ার-ভাটা, চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়মিত খনন, নদীশাসনের কারণে কর্ণফুলী মারা না গেলেও ক্রমাগত দখলে দূষণে বিপর্যস্ত, মুমূর্ষু অবস্থা। এ নদীর উজানে হালদা নদী। চট্টগ্রাম ওয়াসা হালদা ও কর্ণফুলীর পানি সরবরাহ করে শহরের অর্ধকোটি মানুষের বাসাবাড়িতে। অপচনশীল কঠিন বর্জ্য, অপ্রতিরোধ্য গতির দখল, ভয়াবহ দূষণে নদী ভরাট হলে জোয়ারে লবণাক্ত পানি উজানে চলে যাবে। তখন যে কী হবে তার নমুনা সম্প্রতি নগরবাসী দেখেছেন। এ নদীর দুই পাড়ে যে লাখো মানুষের বসবাস করছে তাদের জীবিকার কী হবে? নদীই যদি না বাঁচে তাহলে বন্দর বাঁচবে? কর্ণফুলী নদী গবেষক অধ্যাপক ইদ্রিস আলী জানান, খালের মুখে জাল বসালে নিঃসন্দেহে বর্জ্য আটকাবে। কোনো ধরনের জাল, জালের ছিদ্রের আকার কেমন হবে? সেই বর্জ্য অপসারণ করবে কারা, কীভাবে? সত্যি কথা হচ্ছে দেহের ক্যান্সার সেল যেমন সব উপড়ে ফেলতে হয়, তেমনি নদী বাঁচাতে দূষণের সব পথ বন্ধ করে দিতে হবে। খাল দিয়ে কঠিন বর্জ্য আসছে কেন? কারা ফেলছে? কেন ফেলছে? আমি দেখেছি নদীর দুইপাড়ে যে লাখো মানুষের বসবাস, জীবিকা তাদের কী হবে! নদীই যদি না বাঁচে তাহলে বন্দর বাঁচবে? আমরা বাঁচব? তাই যেকোনো মূল্যে প্রাকৃতিক সম্পদ কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে হবে। শুনেছি চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষ খালের মুখে নেটিং করে দেবে। এটি হলে কঠিন বর্জ্য নদীতে পড়বে না, খালেই আটকে যাবে। আমি দেখেছি বেশ কিছু খালে এতো কঠিন বর্জ্য জমেছে তার ওপর দিয়ে মানুষ হাঁটছে। খালের মুখে জাল বসানো হচ্ছে সনাতন পদ্ধতি। চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে পাইলট প্রকল্প নিতে পারে। তাহলে অনেক বিষয় জানা যাবে, অভিজ্ঞতা হবে। এক্ষেত্রেও সাফল্যের জন্য সততা ও একনিষ্টতা থাকতে হবে। পাশাপাশি বর্জ্য ঠেকাতে যথাযথ উদ্যোগ, কঠোর পদক্ষেপও চাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর। অভিযোগ উঠেছে, কর্ণফুলী ভরাট করে ভূমির ব্যবসা চলছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির দাম বৃদ্ধির সুবাদে জমির ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এই অপতৎপরতাও বেড়ে গেছে।

গবেষকদের অভিযোগ, কর্ণফুলীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দিলেও সেই আদেশ লঙ্ঘন করে নদীকে হত্যা করা হচ্ছে। এই নদীর সঙ্গে ২ কোটির বেশি মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। জানা যায়, শহরের সকল বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে। এটি জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতি। উন্নত শহরে এসব নেই। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উদ্যোগে চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, বন্দর ও জেলা প্রশাসনকে দিয়ে এই নদীকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বন্দর দিবসের মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, কর্ণফুলী নদী মানেই তো চট্টগ্রামবন্দর। কর্ণফুলী আমাদের হৃদয় (হার্ট)। এত ভাগ্যবান যে আমরা, এত চমৎকার একটি নদী বাংলাদেশে রয়েছে। এ নদীর ওপরই আমাদের ঐতিহাসিক এ বন্দর। সেই নদী সত্যিই আমাদের মায়ের মতো। মাকে যেমন আমরা অন্তর দিয়ে ভালোবাসি তেমনি কর্ণফুলী নদী সেই রকম। এ নদী রক্ষায় চট্টগ্রামবন্দর সবসময় খুবই সচেতন। পোর্ট লিমিটের অংশে সারা বছর নাব্য রক্ষায় খনন করি, বর্জ্য অপসারণ নিয়মিত করে যাচ্ছি। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করি আমরা। নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলেই। যাতে এপাড় ওপাড় দখল, অবৈধ স্থাপনা, পরিবেশ দূষণ করতে না পারে। আমাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরের বর্জ্য খাল দিয়ে নদীতে এসে পড়ে। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক আন্দোলন হয়েছে। এখন বন্দরের পক্ষ থেকে নেটিং নিজেরাই করে দেবো চিন্তা করছি। যত খাল আছে, সব খালের মুখে চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষ নেটিং করে দেবে। ঠিকাদার করল কি করল না, অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ করল কি করল না সেটি আমরা দেখতে যাব না। যাতে এ খালগুলো দিয়ে কোনো বর্জ্য না পড়ে তার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি- চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষ থেকে আমাদের অর্থ ব্যবহার করে নেটিং করে দেব। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, জনসাধারণের অসচেতন ও বেপরোয়া ব্যবহারে দিন দিন কর্ণফুলী নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দখল ও ভরাটের করাল গ্রাসে এই নদীর মতো অনেক নদী মরে গেছে।

নদী বাঁচলে জীবন বাঁচবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই নদীকে বাঁচাতে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্ণফুলীতেই চট্টগ্রামবন্দর। দেশে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো বিকল্প বন্দর নেই। দখল-দূষণে কর্ণফুলী যদি গতিপথ হারায়, তখন বন্দর বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কর্ণফুলী রক্ষায় সকল আয়োজন চট্টগ্রাম বন্দরকেই করতে হবে। অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরও কর্ণফুলীতে ড্রেজিং করা হয়নি। দু’পাড় এখনো দখলমুক্ত করেনি। হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, নতুন করে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা। অন্যদিকে, কর্ণফুলী নদী গবেষকরা বলছেন, কর্ণফুলী সুরক্ষায় এ মুহূর্তে দু’টি বিষয় জরুরি। এক. দূষণরোধ এবং দুই. অবৈধ দখলকৃত স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ। তাহলে কর্ণফুলী আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।