ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লাগামহীন রশি টানাটানি

মুদ্রাস্ফীতি না সিন্ডিকেটে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য

মুদ্রাস্ফীতি না সিন্ডিকেটে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য

বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে দিনের পর দিন দ্রব্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাজারে হঠাৎ ডিমের ডজন ২০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ টাকায়। ডিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ে পেঁপের দাম। দেশের ইতিহাসে এবারই পেঁপের কেজি সর্বোচ্চ ১০০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। আবার সামনে ঈদুল আজহা এ সময় মসলার চাহিদা বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। এর মধ্যেই মসলার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এলাচি, জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, ধনিয়া, শুকনা মরিচ ও হলুদের দামও গত বছরের তুলনায় বাড়তি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে মসলার দাম বৃদ্ধি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি করা সব ধরনের মসলার দাম। এভাবে লাগামহীনভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ হিমশিমে পড়েছে।

জানা যায়, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরিণ সিন্ডিকেটকে দোষারোপ করা হয়। আবার কখনো কখনও মুদ্রাস্ফীতি’কে কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আসলে বাজারে দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে হিমশিমে পড়ছে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর। ফলে কোনোভাবেই দ্রব্যের দাম এক জায়গায় থাকছে না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পরিবর্তন করা হয়। সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টাঙ্গাইল-৬ (নাগরপুর-দেলদুয়ার) আসনের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম টিটু। এরপরই অস্থির বাজার সামাল দিতে বাজারে ছুটে যান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী। তখন এক ব্যবসায়ী বাজারে আলুর দাম ৩৫ টাকা চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আলুর দাম ৩৫ টাকা কেন? কত করে কিনছো তোমরা। প্রতিমন্ত্রীর এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ী বলেন ২৮ টাকা কেজি কেনা হয়েছে। এরপর আবার বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, কালকেই আলুর কেজি ছিল ২৯ টাকা, সব জায়গায় ২৯ টাকা বিক্রি করে, শুধু কাঁচাবাজারে আলুর কেজি ৩৫ টাকা। বাজার পরিদর্শনের সেই ঘটনা মিডিয়া ব্যাপক প্রচারণা চালায়। বর্তমানে বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীকে বাজার মনিটরিংয়ে দেখা মিলছে না। সেজন্য অনেকেই প্রশ্ন করছেন- সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে লোক দেখানোর কাজ করেছিলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে মন্তব্য করছেন, যা কতটা যুক্তিক, যার সুযোগ নিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। দেশে পণ্যবাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা রয়েছে। খোদ সরকারিভাবেই স্বীকার করা হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য এবং সেক্ষেত্রে সরকারের নীরবতা। বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ও নীতিগত দুর্বলতার কথাও বলা হচ্ছে। তাহলে সেই দুর্বলতা দূর করার প্রক্রিয়া বা চেষ্টা কেন নেই? একটি ক্ষুদ্র ধনিক শ্রেণি ছাড়া সব স্থির আয়ের মানুষের জীবন যে অসহনীয় হয়ে উঠছে। বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যদি সমন্বয় না থাকে, তাহলে তা দামের ওপর প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কতটা সরবরাহ ঘাটতির বিপরীতে কতটা দাম বাড়তে পারে তার একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকাটাও স্বাভাবিক।

আন্তর্জাতিক বাজারে যদি কোনো পণ্যের দাম আজ রাতে বেড়ে যায়, তাহলে পরদিন সকালেই দেশে তার দাম বেড়ে যায়। মনে হবে, গত রাতেই উচ্চমূল্যের আমদানি পণ্য ব্যবসায়ীর হাতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু যদি আজ রাতে কোনো পণ্যের দাম আন্তর্জাতিকভাবে কমে যায়, তাহলে তার দাম তিন মাসেও দেশীয় বাজারে কমে না। তখন শুনতে হবে, আগের দামে কেনা। অসহায়ত্ব ঘোচানোর কোনো আগ্রহ বা চেষ্টা সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের মধ্যে নেই। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেই সরকার দাম বেঁধে দেয়, কিন্তু সেগুলো খুব কমই কার্যকর হয়। কারণ, বাজার তদারকি সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে অভিযান না চালিয়ে যে যার মতো করে খুচরা বাজারে হানা দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ উদ্যোগের ফলাফল বরাবরের মতো ব্যর্থ হতে চলেছে।

বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, পাগলা ঘোড়াকে একবার মাঠে ছেড়ে দেওয়ার পর তার লাগাম টেনে ধরা খুবই কঠিন। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যমূল্যের ক্ষেত্রে আমরা আগে বাজার ছেড়ে দিয়েছি, সেখানে আমার কোনো কিছুই করিনি। ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের লোভ তৈরি হয়েছে। বাজার নিয়ে তারা নানা খেলা খেলেছে। এ সময় আকস্মিক কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হলে স্বাভাবিকভাবেই তা ব্যর্থ হয়। বছরজুড়ে চাহিদা ও জোগান পর্যালোচনা করে নিত্যপণ্যের উপযুক্ত দাম নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। তার মতে, উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর- এই দুই পর্যায়ে যারা মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে বাজারটা একচেটিয়াভাবে চলে গেছে। তারা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এ কারণে যে মূল্যটা সেটা বাজারের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার নিরিখে হচ্ছে না। তিনি বলেন, এই মধ্যস্বত্বভোগীরাই বাজারের মূল্য নির্ধারণ করছে এবং অনেক সময় সরবরাহকে প্রভাবিত করছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে অব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সামনে এনেছেন অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানও। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ীরা একটা সাময়িক সরবরাহ সংকট তৈরি করে কোনো কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে ফেলে। যেটার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। চিনি বা ভোজ্যতেলের মতো খাতে সরবরাহকারীর সংখ্যাও হাতেগোনা, মাত্র তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বাজারকে প্রভাবিত করার প্রবণতা আছে বলে মনে করেন তিনি। বাজারে অ্যান্টি-কমপিটিটিভ প্র্যাক্টিসের (প্রতিযোগিতাহীন অবস্থা) নিদর্শন পাওয়া যায়, অথচ এগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখা যায় না।

দেশের বাজারে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে বড় ধরনের দুর্বলতা থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, বাজারে চাহিদা কত, সরবরাহ কত, উৎপাদন কত, আমদানি কতটুকু করতে হবে এবং সেটা কোন সময়ে করতে হবে, সেই আমদানিটা উন্মুক্তভাবে হচ্ছে কি না- এসব তথ্যের ভিত্তিতে বেশির ভাগ সময়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। ফলে যথেচ্ছভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব মনে করে সিন্ডিকেট ভেঙে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি আছে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পেঁয়াজের মূল্য দ্বিগুণ হওয়া এবং পেঁয়াজ আমদানির খবর পাওয়ার সঙ্গে দাম কমে যাওয়া।

ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমরা মনে করি এটা সুশাসনের ঘাটতি। ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে, সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। আর সরকারের বিভিন্ন বিভাগ যারা যুক্ত তাদের নীরবতার প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

এদিকে সত্যিকার অর্থে সরকার পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই করতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে। কারা এই বাজার কারসাজি করছে, সরকার যে জানে না, এমন নয়। এখন তারা সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কি না- সেটিই প্রশ্ন। সেটি করতে গেলে আমদানিকারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পণ্য সরবরাহ, পণ্যের দাম ইত্যাদি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। এখন একটি পণ্যের দাম বাড়ল, তখন হইচই পড়ে গেল আর সেই পণ্যের জন্য দুই-একটা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর আরেকটা পণ্যের দাম বাড়ে, এরপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকে। এটি এ দেশে নতুন কিছু নয়। এখন সামগ্রিক একটা ব্যবস্থাপনা বা কাঠামো থাকলে সিন্ডিকেটের সুযোগ নেওয়া কঠিন হতো। সেই ব্যবস্থাপনা থাকলে, প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয়। কোন দেশের পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, কী ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়, কোন দেশ থেকে পণ্য আনতে কেমন সময় লাগবে- এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এখন পণ্যের দাম বাড়ে, আমদানির সিদ্ধান্ত ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নিতেই ভোক্তার পকেট খালি হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, পাড়া-মহল্লার দোকানেও ৫৫ টাকা হালি ডিম বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। যা সপ্তাহখানেক আগেও ছিল ৪৫ টাকা, আর দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৪০ টাকা। এক কেজি বেগুনের দাম এখন ১০০ থেকে ১২০ টাকা। প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারে পেঁয়াজের দাম নতুন করে বাড়তে দেখা গেছে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, যা আগের চেয়ে ৫ টাকা বেশি। এছাড়া আদা কিংবা রসুন ২২০ থেকে ২৪০ টাকার নিচে মিলছে না। অন্যদিকে, সোনালি মুরগি ৪০০-৪২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ৮০ টাকা বেশি। তবে ব্রয়লার ২২০ থেকে ২৩০ টাকার মধ্যে কেনা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত