ওকাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে স্থায়ী সমাধান জরুরি

প্রকাশ : ২০ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার ও উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন সংকট এখন আঞ্চলিক সংকটে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে এই সংকট আরো গভীর হতে পারে। তাই দ্রুততম সময়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পূর্ণ নাগরিক মর্যাদায় প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা জরুরি এবং এটাই একমাত্র স্থায়ী সমাধান।

একইসাথে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ভারত ও চীনকে আরো নিবিড়ভাবে যুক্ত করা গেলে সংকট দ্রুত সমাধান সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে ওভারসিজ করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশে’র (ওকাব) ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সংকট : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কূটনৈতিক পথ অবলম্বন করছি। একই সঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে গেছি।

‘আমরা গাম্বিয়া ও ওআইসির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করেছি, সেই মামলায় এখন পর্যন্ত যে ‘আউটকাম’ এসেছে, সেটি আমাদের পক্ষে’ জানিয়ে তিনি বলেন, গাম্বিয়া বলেছে, মামলা সঠিক পথে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত এই মামলার ইতিবাচক আউটকাম আসবে।

ড. হাছান বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আইসিজে’র মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক চাপ মিয়ানমারের ওপর পড়বে। আমরা ক্রমাগতভাবে চেষ্টা করেছি, আন্তর্জাতিকভাবে যেসব দেশের প্রভাব মিয়ানমারের ওপর আছে, তাদের এই বিষয়ে যুক্ত করার। কয়দিন আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। তার সঙ্গেও রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনায় সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু পরামর্শ তিনি আমাদের দিয়েছেন।

এ সময় বছরের শুরুতে উগান্ডায় মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ওই বৈঠক থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়ানোর জন্য হলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাখাইন প্রদেশে এখন যে পরিস্থিতি, সেখানকার সেনাবাহিনী পালিয়ে আমাদের এখানে আসছে। এটিকে অন্তরায় মনে হলেও গত ৬০ থেকে ৭০ বছর ধরে মিয়ানমারের পরিস্থিতি কখনোই তেমন শান্ত ছিল না। তাই এর মধ্যেই আমাদের চেষ্টা এগিয়ে নিতে হবে।’

‘রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন’ উল্লেখ করে মন্ত্রী হাছান বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ দিতে বলেছে। ক্যাম্পে তারা কিছু কাজ করছে। কিন্তু তাদের পুরোপুরি জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা আমরা কীভাবে দেব? রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা সমাধান নয়। একমাত্র সমাধান হচ্ছে সব অধিকারসহ তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওকাবের কার্যকরী কমিটির সদস্য ফরিদ আহমেদ। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের অব্যাহত অবস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গারা মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, সন্ত্রাসী তৎপরতা, পাচারের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। অনেকে মানব পাচারকারীদের শিকার হচ্ছেন এবং ক্যাম্প থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে ভ্রমণের চেষ্টা করছে। এমনকি তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও এনআইডি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মানবিক দিক ও প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে জোরারোপ করেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখনো বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা। এই সংকটের আরো অনেক গভীরে যেতে হবে। যত দিন যাবে এই সমস্যার গভীরতা আরো বাড়বে। তাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সমাধানে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে একযোগে উদ্যোগী হতে হবে।

এ সময় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। এছাড়া ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ, ডিক্যাব সভাপতি নুরুল ইসলাম হাসিব প্রমুখ সেমিনারে বক্তব্য দেন। বক্তব্য শেষে উপস্থিত অতিথিরা ওকাব সদস্যদের সাথে সংগঠনের ৪৫ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে কেক কাটায় অংশ নেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মিয়ানমারের বিদায়ি রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ : গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন মিয়ানমারের বিদায়ি রাষ্ট্রদূত অং কিও মো। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই চলমান পরিস্থিতির একমাত্র সমাধান উল্লেখ করে মন্ত্রী ড. হাছান রাষ্ট্রদূতকে বলেন, চলতি বছর উগান্ডায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু করতে চান বলেই মতপ্রকাশ করেছেন। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি অন্ততপক্ষে শুরু করার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার তাদের সদিচ্ছার সাক্ষর রাখতে পারে।

রাষ্ট্রদূত অং কিও মো মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তাদের সেনাবাহিনী ও বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর চলমান সশস্ত্র সংঘাতকে এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে বর্ণনা করেন তবে তার দেশ এ বিষয়ে আরো সচেষ্ট হবে বলেও আশ্বাস দেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা বিষয় ছাড়াও বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিকে আলোকপাত করেন তারা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সমন্বয় সভা : গতকাল বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘সিনিয়র অফিশিয়ালস মিটিং’য়ে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন পরিচালিত এ সভায় কূটনৈতিক ও দাপ্তরিক বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন মন্ত্রী। অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব ড. নজরুল ইসলাম ও সকল উইংয়ের মহাপরিচালকরা সভায় অংশ নেন।

সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সাথে সুসমন্বয়, দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম তদারকি, প্রবাসী সেবার মানবৃদ্ধি, মিশনগুলোর ট্রেড টার্গেট বাস্তবায়ন ও কার্যক্রম ইনস্পেকটর জেনারেল অব মিশনসে’র মাধ্যমে পরিদর্শনসহ মন্ত্রণালয় ও এর মিশনসমূহের নানা কার্যক্রমের ওপর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন মন্ত্রী ড. হাছান।