ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত

ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন। গত রোববার দুর্ঘটনা ঘটলেও গতকাল প্রেসিডেন্টের নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে ইরানি কর্তৃপক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক স্থানে চলমান সংঘাতের মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ানের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। হেলিকপ্টারে থাকা পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রহমাতিসহ আরও কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।

এর আগে রোববার আজারবাইজানের সীমান্তের কাছে দুটি বাঁধ উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট রাইসি। এরপর হেলিকপ্টারে চড়ে ইরানের উত্তর-পশ্চিমের তাবরিজ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাবরিজ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি। প্রেসিডেন্টের বহরে মোট তিনটি হেলিকপ্টার ছিল। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে অবতরণ করলেও ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। নিরাপদে ফেরা হেলিকপ্টারে ছিলেন ইরানের জ্বালানি মন্ত্রী আলী আকবর মেহরাবিয়ান এবং আবাসন ও পরিবহনমন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাশ। গতকাল সকালে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পাহাড়ি ও তুষারাবৃত এলাকায় ইরানি প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অনুসন্ধানী দল। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়, সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। পুরো হেলিকপ্টার ভস্মীভূত হয়।

ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারী বৃষ্টিপাত আর ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইটের দৃষ্টিসীমায় ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে এই দুর্ঘটনায় শত্রুপক্ষের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়েও জল্পনা ছড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মেয়াদ ও ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় শত্রু, এমনকি ইসরায়েলের মতো বহিরাগত ক্রীড়নকদের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়েও আলাপ উঠেছে।

প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে ইরানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পাঁচ দিনের জাতীয় শোক পালন করা হবে। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনি জানিয়েছেন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মোখবারকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মোখবার দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করবেন এবং ৫০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। অন্যদিকে রাইসির সঙ্গে তার সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আব্দোল্লাহিয়ানের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন বর্তমান উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলি বাঘেরি কানি। এই ঘটনায় অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ইরান; যার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু কেবল ইরানের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সূত্রপাতই করবে না, বরং ওই অঞ্চলেও তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ক্রমবর্ধমান তীব্র উত্তেজনা আর সংঘাতের মাঝে রাইসির মতো দেশটির প্রধান একজন রাজনৈতিক নেতার অনুপস্থিতি ইরানের ভেতরে এবং বাইরে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের পরও দেশটির আন্তর্জাতিক ভূমিকায় কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না মনে করছেন ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট নিউক্লিয়ার ইরানের পলিসি ডিরেক্ট জ্যাসন ব্রডস্কি। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ইরানের প্রেসিডেন্ট একজন নীতি বাস্তবায়নকারী, তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নন। ফলে ইরানের মৌলিক নীতিগুলো আগের মতোই থাকবে। রেইখমান ইউনিভার্সিটির ওরি গোল্ডবার্গ বলেছেন, সর্বোচ্চ নেতার হয়ে কাজ করতেন রাইসি। ইরানের সবচেয়ে কম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন। কিন্তু একই সময়ে ইরানের প্রেসিডেন্টের আকস্মিক মৃত্যু ক্ষমতার কেন্দ্রে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে। সরকারে শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিরা হয়তো এর সুযোগ নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করতে পারেন।

ইরানের সংবিধানের ১৩১ ধারা অনুসারে, প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে প্রথম ডেপুটি অন্তবর্তী সময়ের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। এই হিসেবে খামেনির অনুগত প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমন সুযোগের অপেক্ষায় থাকা প্রভাবশালী ইরানি কর্মকর্তাদের কোনো ঘাটতি নেই। তারা ক্ষমতা কাঠামোর আরও ওপরে উঠতে চান। আর রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনাটি খোদ খামেনিকেই একটি পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে। গোল্ডবার্গ বলেছেন, খামেনিকে এই ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে নেতা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালনে কতটা সক্ষম।

গুরুত্বপূর্ণ হলো রাইসিকে খামেনির একজন সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ, একজন মাওলানা, সাবেক প্রধান বিচারপতি ও একটি বড় প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান। তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া বা অক্ষম কিংবা মৃত-যেভাবেই বলা হোক না কেন তা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন ইরানের পলিসি ডিরেক্ট জ্যাসন ব্রডস্কি। রাইসির কারণে আড়ালে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আব্দোল্লাহিয়ানের মৃত্যুও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খুব সক্রিয় ছিলেন। সৌদি আরবের সঙ্গে সফলভাবে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চুক্তিতে ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিবেশী পাকিস্তানসহ বিভিন্ন কঠিন সংকট সফলভাবে সামলে নিয়েছেন।

ইসরায়েল সীমান্তে ইরানের গ্রহণযোগ্যতাও চাপে পড়েছে। তবে গাজায় হামাস নেতাদের অবস্থান শনাক্ত বা নিশানা করতে হিমশিম খেলেও সিরিয়ায় ইরানি কর্মকর্তাদের হত্যা করতে নিজের সক্ষমতা ও ইচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে ইসরায়েল। এপ্রিলে সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডার মোহাম্মদ রেজা জাহেদি ও তার ডেপুটি মোহাম্মদ হাজ রাহিমিকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ডিসেম্বরে একই বাহিনীর সিনিয়র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাজি মৌসাভি দামেস্কে একটি সন্দেহভাজন ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে ইরানকে নিজেদের আঞ্চলিক প্রক্সি বাহিনী ও নাগরিকদের কাছে প্রমাণ করতে হতে হতো যে তারা ইসরায়েলের ক্ষতি সাধন করতে পারে। বিশেষ করে গত বছর ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক হামলার পর এই চাপ বেড়েছে। কিন্তু সিরিয়ার হামলার ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে ইরান যে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল তাতে ইহুদি রাষ্ট্রটির কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং নিজেদের প্রতিরক্ষার পক্ষে পশ্চিমা ও কয়েকটি আরব দেশকে পাশে পেয়েছে।

১৯৮৮ সালে ইরানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও পরবর্তীতে দেশটির পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তার নেতৃত্বেই ইরানের সামরিক বাহিনী কিছুদিন আগে আঞ্চলিক চিরবৈরী ইসরায়েলের ভূখণ্ডে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান এবং ইসরায়েলের ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরায়েলের একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরবর্তীতে ইসরায়েলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনায় সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা বিবেচনায় এই তত্ত্বটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত