ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সরকারের স্মার্ট ইকোনমি বাস্তবায়নে এসএমই খাতের গুরুত্ব বাড়ছে

সরকারের স্মার্ট ইকোনমি বাস্তবায়নে এসএমই খাতের গুরুত্ব বাড়ছে

দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আরো দৃঢ় করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তায় জাতীয় অর্থনীতির চাকা সমৃদ্ধ করছে। নতুন উদ্যোক্তাদের আরো বেশি উৎসাহ দিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই) কাজ করছে। ফলে এসএমই ঋণের চাহিদা বেড়েছে।

গত রোববার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শতভাগ দেশি পণ্যের সবচেয়ে বড়ো আয়োজন ১১তম জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পণ্যমেলা উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাত দিনব্যাপী (১৯ থেকে ২৫) মেলা চলবে। এতে সাড়ে তিনশরও বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী নারী উদ্যোক্তা। এবারের মেলায় পোশাক খাতের ৭৫টি, পাটজাত পণ্যের ৪২টি, হস্তশিল্পের ৩৮টি, চামড়াজাত পণ্যের ৩২টি, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের ২৭টি, হালকা প্রকৌশল পণ্যের ২৩টি, খাদ্যপণ্যের ১৪টি, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক (আইটি) পরিষেবা ১৩টি এবং ভেষজ শিল্পপণ্যের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানের ১২টি এসএমই ক্লাস্টারের উদ্যোক্তারা মেলায় অংশ নিয়েছে। অন্যান্য খাতের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের চারটি, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস খাতের তিনটি, আসবাব খাতের তিনটি ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১৯টি স্টল মেলায় রয়েছে। এছাড়া ৩০টি ব্যাংক, ১৫টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ক্লাব ও প্রায় ৫০টি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশগ্রহণকারীদের সেবা দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতকে সংক্ষেপে এসএমই খাত বলে বিবেচনা করা হয়। নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শতভাগ দেশি পণ্যের বহুমুখী ব্যবসায় সম্পৃক্তকরণ এসএমই ফাউন্ডেশনের অন্যতম লক্ষ্য। সারা দেশে আঞ্চলিক এসএমই পণ্য মেলার আয়োজন করা হয়। এসব মেলায় স্থানীয় পণ্য বিক্রি করা হয়। সেখানে বিদেশি পণ্য বিক্রয় বা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। নারী উদ্যোক্তারা নতুন নতুন পণ্য তৈরি করছে। স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প অর্জনে নির্ধারিত চারটি ভিত্তির মধ্যে অন্যতম স্মার্ট ইকোনমি অর্জনে দেশের এসএমই খাত অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। তবে সামগ্রিকভাবে এ খাতের উদ্যোক্তারা বিশেষত প্রান্তিক। এখনো তাদের ব্যবসা পরিচালনা ও সম্প্রসারণে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সহজ অর্থায়নের অভাব। যদিও অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ খাতের উদ্যোক্তাদের অর্থের চাহিদা পূরণে উদ্যোগী হচ্ছেন যা বাস্তবে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এসএমই খাতের উদ্যোক্তা বিশেষত প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের জন্য যুগোপযোগী অর্থায়ন প্রয়োজন।

এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করোনা মহামারির সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ও ঘূর্ণমান তহবিল থেকে ৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা ঋণসুবিধা পেয়েছেন। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের ৩০০ কোটি টাকা পেয়েছেন ৩ হাজার ১০৮ জন উদ্যোক্তা। আর ফেরত পাওয়া অর্থে গঠিত ঘূর্ণমান তহবিল থেকে ২৯৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৯৭৮ জনকে। ঘূর্ণমান তহবিল থেকে ঋণ পাওয়া উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ শতাংশ নারী। সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তারা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের শিল্প স্থাপন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ঋণের চাহিদা বেড়েছে। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সাধারণত ছোট আকারের ঋণ সরাসরি দিতে চায় না। সেজন্য এসএমই ঋণের পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন।

এসএমই নীতিমালা বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। এসএমই একটি শ্রমনিবিড়, স্বল্পপুঁজি নির্ভর ও পণ্য উৎপাদনে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। সহায়ক নীতি ও উপযুক্ত পরিবেশ, টেকসই ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান এবং অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত কিন্তু সম্ভাবনাময়ী উদ্যোক্তাদের আর্থিক ও ব্যবসা সহায়ক সেবা দেওয়া হয়।

জানা গেছে, সারাদেশে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পের জন্য সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ঋণসীমা উৎপাদন কুটির শিল্পের জন্য ১৫ লাখ, মাইক্রো ব্যবসা উৎপাদন শিল্পে ১ কোটি, সেবা শিল্প ২৫ লাখ ও ট্রেডিংয়ের জন্য ৫০ লাখ টাকা। ছোট ব্যবসা উৎপাদন শিল্পে ২০ কোটি, সেবা শিল্পে ৫ কোটি, ট্রেডিংয়ে ৫ কোটি টাকা।

এছাড়া মাঝারি ব্যবসা উৎপাদন শিল্পে ৭৫ কোটি এবং সেবা শিল্পের ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। স্বল্প মেয়াদি ১ বছর, মধ্যমেয়াদি ২ থেকে ৩ বছর এবং দীর্ঘমেয়াদি ৪-৫ বছরের জন্য ঋণ দেওয়া হয়। প্রত্যেক জেলার বিভিন্ন ব্যাংক (সরকারি ও বেসরকারি) থেকে একটি ব্যাংককে এসএমই লিড ব্যাংক হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া। এসএমই ঋণ পরিকল্পনার জন্য নির্ধারিত জেলার ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমের সমন্বয়ের জন্য লিড ব্যাংক কনসোর্টিয়াসম লিডার হিসেবে কাজ করছে।

প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এ খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি অন্যান্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখা দরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ব্যাংক ঋণ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি আমাদের দেশেও অনেকগুলো বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা রয়েছে। যাদের মধ্যে ফ্যাক্টরিং ফাইন্যান্স, ওয়ার্ক অর্ডার ফাইন্যান্স, ওয়্যারহাউজ রিসিপ্ট ফাইন্যান্স, লিজিং, রিস্ক শেয়ারিং, সিকিউরিটাইজেশন, ক্রাউড ফান্ডিং, এঞ্জেল ফান্ডিং এবং স্টার্টআপ ক্যাপিটাল অন্যতম। এসএমই উদ্যোক্তাদের বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা একাধারে যেমন প্রথাগত ব্যাংকঋণ ব্যবস্থার ওপর চাপ কমাবে, ঠিক তেমনি উদ্যোক্তারা এর সুফল ভোগ করতে পারবেন, যা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে। স্মার্ট ইকোনোমি গড়ার ক্ষেত্রে সরকার জোর দিয়েছে ক্যাশলেস লেনদেন, মাথাপিছু আয় বাড়ানো এবং দারিদ্র্য কমানোতে। এজন্য কুটির, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বা ছোট ছোট শিল্পসহ বেসরকারি খাতের ডিজিটালাইজেশনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রযুক্তিগতভাবে সক্ষম আর্থিক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ফলে এসএমই খাতে শুধু শিল্প উৎপাদনই বৃদ্ধি পাবে না উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে সক্ষম হবে। সরকারের স্মার্ট ইকোনমি বাস্তবায়নে এসএমই গুরুত্ব বেড়েছে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, পণ্যের বাজার সংযোগ বা বাজারজাতকরণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অন্যতম বাধা। ব্যবসা শুরুর প্রথম পর্যায়ে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা পুঁজি সংকটের কথা উল্লেখ করলেও ২০ শতাংশ তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে পণ্যের বাজারজাতকরণকে চিহ্নিত করেছে। পণ্যের বাজারজাত নিশ্চিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় মেলার আয়োজন হয়।

সারা দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০০৭ সালে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এসএমই ফাউন্ডেশন তৈরি করা হয়। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের তথ্যে এসএমই ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে নারীর অংশ বাড়ছে। ২০১০ সালে শতকরা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৮ সালে শতকরা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ২০০ উদ্যোক্তার মধ্যে সংস্থাটি ১২২ কোটি টাকা বিতরণ করে। বর্তমানে এসএমই ঋণের চাহিদা বেড়েছে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘এসএমই ফাউন্ডেশনে নারী উদ্যোক্তারা বেশি আসছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণে স্বাচ্ছন্দ্য মনে করছেন নারীরা। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। ফলে দিনে দিনে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৫০ হাজার থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ খেলাপি হয়। কিন্তু ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ খেলাপির পরিমাণ খুবই কম। এরপরও ব্যাংকগুলো ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে চায় না। কারণ ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প পরিসরে ঋণ নেয়, আর বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক পরিসরে ঋণ নেয়। ব্যাংকগুলো বড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে তদারকি করতে চায়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বল্প পরিসরে ঋণ দিয়ে, সেটির তদারকির খরচ বাড়াতে চায় না ব্যাংকগুলো।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে দেশের এসএমই খাতের উৎপাদন ছিল ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এ খাতের উৎপাদন ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই স্থিতিশীল ছিল। ১৯৯২ সালের পরে এসএমই খাতের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৪ সালে উৎপাদন দাঁড়ায় ৬ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ২০০০ সালে এটি আরো বেড়ে ৯ হাজার ৪৩৩ কোটি হয়। পরবর্তী ৫ বছরে এটি ১০০ শতাংশের বেশি বেড়ে ২০০৫ সালে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকায়। ১০ বছর পর ২০১৫ সালে এসএমই খাতের উৎপাদন দাঁড়ায় ২০ হাজার ৪০ কোটি টাকায়। ২০২০ সালে বেড়ে ৪৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা হয়। বছরে বছরে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান বাড়ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত