ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মার্টের পথে বাংলাদেশ

* কমবে নাগরিক হয়রানি * অর্থ বিভাগের কর্মপরিকল্পনা
স্মার্টের পথে বাংলাদেশ

ডিজিটালের গণ্ডি পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে দ্রুত গতিতে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো। এরই মধ্যে নাগরিক হয়রানি বন্ধে প্রযুক্তিনির্ভর ভূমি ব্যবস্থাপনা, অর্থ উত্তোলন, স্মার্ট স্কুল বাস, স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিলসহ বিভিন্ন খাতে স্মার্ট ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে। সামনের দিকে শতভাগ স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বাস্তবে রূপ নেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এতে দ্রুত সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠে। এবার প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে ঘোষণা করেন, ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে উন্নত ও স্মার্ট। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। বিটিআরসির হিসাবে, গত বছরের জুলাই শেষে দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী প্রায় ১৮ কোটি ৭৫ লাখ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৩ কোটি ১ লাখ। এ ক্ষেত্রেও সর্বশেষ ৯০ দিনে একবার ব্যবহার করলেই তাকে ব্যবহারকারী ধরা হয়।

দেখা গেছে, সরকারি ও বেসরকারি অন্যালগ সেবা পরিবর্তনে দেড় যুগ আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল, যার সফলতা মানুষ পাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ সেবা উন্নত বিশ্বের মতো ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর ডকুমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি, দেশের পাসপোর্ট সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর মেশিন রিডেবল পাসপোর্টে (ই-পাসপোর্ট) রূপান্তর করা হয়েছে। সব নাগরিকের জন্য ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) চালু করা হয়েছে। ডিজিটালের মতোই শতভাগ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার দিকে বর্তমান সরকার নজর দিয়েছে। সেজন্য শিক্ষা খাতেও উন্নত দেশের মতো কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার গুরুত্ব বাংলাদেশেও বাড়ছে।

স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা : প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের বাসিন্দারা ভূমির নামজারির জন্য অফিসে এসে নামজারির আবেদন করেছেন। আবেদনের পর মাসের পর মাস অফিসে ঘুরতে হয়েছে। বর্তমানে ভূমির নামজারি আবেদন অনলাইনে করা যাচ্ছে। আবেদন দাখিলের সময় আবেদন ফি ২০ টাকা ও নোটিশ জারি ফি ৫০ টাকা- মোট ৭০ টাকা শুধুমাত্র অনলাইনে পরিশোধ করতে হবে। এজন্য নগদ, রকেট, বিকাশ, উপায়, ভিসা কার্ড, মাস্টার্ড কার্ডসহ অন্যান্য ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ঘরে বসেই জমির মালিকরা ‘ই-নামজারি’র জন্য ডিসিআর ফি ১ হাজার ১০০ টাকা অনলাইনে জমা দিয়ে নামজারি করতে পারেন। অর্থ লেনদেন অনলাইন ও মোবাইলের মাধ্যমে করা যাচ্ছে।

স্মার্ট স্কুল বাস : চট্টগ্রামে স্মার্ট স্কুল বাস নামানো হয়েছে। স্কুল বাসে জিপিএস ট্র্যাকার, জিআইএস প্রযুক্তি, ডিজিটাল হাজিরা ডিভাইস ও আইপি ক্যামেরা স্থাপন করে এসব বাসকে ‘স্মার্ট’ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বাসে উঠে বা নামার সময় হাজিরা যন্ত্রের সামনে স্মার্ট কার্ড চাপ দিলেই অভিভাবকদের মোবাইলে এসএমএস চলে যায়। ঘরে বসেই জিপিএস ট্যাকিং ও সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে বাস ও শিক্ষার্থীর অবস্থানও দেখতে পারবেন অভিভাবকরা।

স্মার্ট অর্থ বিভাগের কর্মপরিকল্পনা : দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, উইথ স্মার্ট ইকোনমি; অর্থাৎ, অর্থনীতির সব কার্যক্রমে প্রযুক্তি ব্যবহার করা স্মার্ট পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্মার্ট এনার্জি, স্মার্ট শহর/গ্রাম, স্মার্ট পাবলিক সার্ভিস, স্মার্ট স্থানীয় সরকার, স্মার্ট সোশ্যাল সেফটি নেট, কাগজবিহীন প্রশাসন, স্মার্ট পরিকল্পনা, স্মার্ট প্রকিউরমেন্ট, স্মার্ট আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ক্যাশলেস লেনদেন, ই-মার্কেটপ্রেস, স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেম, প্রযুক্তি-নির্ভর পণ্য সেবা আমদানি-রপ্তানি, স্মার্ট আইডি, স্মার্ট কর্মসংস্থান, স্মার্ট সাইবার নিরাপত্তা, স্মার্ট ডিজিটাল অবকাঠামোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের সংস্থাপনের একটি শাখায় কাগজবিহীন প্রশাসন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের অনলাইনে লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে কেনাকাটার বিল পরিশোধ করা যায়। অর্থ স্থানান্তর এবং বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের বিল বা ফি পরিশোধ করা হচ্ছে। পেনশনার হিসেবে জীবিত প্রমাণ করার জন্য সশরীরে পে-পয়েন্টে হাজির হওয়ার ভোগান্তি লাঘব করতে ঘরে বসে বা যে কোনো জায়গা থেকে পেনশনাররা স্মার্ট মোবাইলের মাধ্যমেই জীবিত থাকার বিষয়টি ভেরিফিকেশন করতে পারবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কম সময়ে যেকোনো জায়গা থেকে কোনো খরচ ছাড়াই বিল দালিখ ও অর্থ গ্রহণ করা যাচ্ছে।

স্মার্ট ঢাকা ওয়াসা : ঢাকায় ২ কোটি মানুষের পানি সরবরাহের কাজ করছে ঢাকা ওয়াসা। স্মার্টের পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। পানি ও পয়ঃসংযোগ, বিল অনলাইন পেমেন্ট, বাজেট ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল হাজিরা ও অডিট ব্যবস্থাপনাসহ ৩০টির বেশি কার্যক্রম স্মার্ট করেছে। স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে পানি সংগ্রহ করা যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকায় ৩শ’র কাছাকাছি এটিএম বুথ চালু আছে, যার গ্রাহক সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখের কাছাকাছি।

ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ঢাকা ওয়াসা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট বলতে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রাহক ভোগান্তি ছাড়াই ঘরে বসে ঢাকা ওয়াসার সেবা পাবেন। পানির পাম্পে সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডাটা একুইজিশন (এসসিএডিএ) স্থাপনে ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপ দ্বারা গভীর নলকূপের অপারেশন, কন্ট্রোল ও মনিটরিংয় ব্যবস্থা চালু করে পরিচালনা ব্যয় কমানো হয়েছে।

স্মার্ট ঢাকা ওয়াসা গঠনে ইনোভেশন টিম গঠন করা হয়েছে। স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট স্লোগান সামনে রেখে ই-গভর্ন্যান্স প্রণয়নে ইনোভেশন টিম গঠন করা হয়েছে। ইনোভেশন টিম বার্ষিক ই-গভর্ন্যান্স ও উদ্ভাবন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, মূল্যায়ন ও রিপোর্টিয়ের কাজ করবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভিশন-২০৪১’র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজিটাল ওয়াসা থেকে স্মার্ট ওয়াসায় রূপান্তরের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে।

স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা : স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিকরা কৃষির উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ সব প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এখন কৃষি উৎপাদনের বহু তথ্য ডিজিটাল সিস্টেমে সংগ্রহ করে। ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকরা জমির উর্বরতা নির্ণয় ও সার প্রয়োগ, উন্নত জাতের বীজ সংগ্রহ, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমনের সব তথ্য ঘরে বসেই সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।

ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি : বাংলাদেশকে পরিবেশবান্ধব ক্লাইমেট স্মার্ট দেশে পরিণত করতে হবে। বনায়ন ও ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সে বিষয়ে জনগণকে প্রযুক্তিগত তথ্যের অবাধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্মার্ট নাগরিকে পরিণত হবে। ভবিষ্যতে স্মার্ট নাগরিকরা পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা : রাজধানীতে যানজটের ঘটনা নিত্যদিনের ছিল। সেই যানজট কমিয়ে আনতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় মেট্রোরেল যোগ হয়েছে। যোগাযোগ খাতে মেট্রোরেল স্মার্ট যুগে প্রবেশের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর পরই নদীর তলদেশে নির্মিত হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। এই দুটি প্রকল্প বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহণ খাতে নতুন যুগে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। রাজধানীতে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকায় মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়, কাজের উদ্যম কমিয়ে দেয়। মেট্রোরেল চালু হওয়ায় মানুষের যাতাযাতে সেই ভোগান্তি নেই, কর্মঘণ্টা কাজে লাগছে। অন্যদিকে কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম শহর ও আনোয়ারার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে ঢাকা বা দেশের যে কোনো এলাকা থেকে কক্সবাজার বা দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী যানবাহন চলাচলের সময় ও দূরত্ব কমেছে। টানেল খোলার পর আনোয়ারা সদর থেকে টানেল পেরিয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিট। এর মধ্যে টানেল পার হতে সময় লাগে সাড়ে ৩ মিনিট।

স্মার্ট বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবস্থাপনা : আগের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অফিসে বিল দিতে হয় না গ্রাহকদের। তাদের সেবা সহজীকরণে স্মার্টের ছোঁয়া লেগেছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে। এখন গ্রাহকরা কার্ড কিনে মিটার রিচার্জ করতে পারেন। স্মার্ট মিটারে সরাসরি মোবাইল থেকে রিচার্জ করা যায়। কার্ড কেনা ও রিচার্জের ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য স্মার্ট মিটার করা হয়েছে। অন্যদিকে গ্যাসেও প্রি-পেইড মিটারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখন তিতাসের প্রি-পেইড মিটারে বিল দিতে পারছেন গ্রাহকরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত