ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’

* সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত * সমুদ্র এলাকা ঝুঁকিতে * নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ
ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ায় উত্তাল হয়ে উঠেছে সমুদ্র। গভীর নিম্নচাপটি যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। কারণ গভীর নিম্নচাপটি দ্রুত উপকূলের দিকে এগোচ্ছে, বাড়ছে শক্তিও। তাই সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। সাগরের মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে অতি দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি উত্তরদিকে অগ্রসর হয়েছে। গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমণ্ডমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ নির্দেশনা দিয়েছে, পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত নিম্নচাপের কারণে উপকূলে নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর ও ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে।

গতকাল সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিলে এর নাম হবে ‘রেমাল’, আরবি এই শব্দের অর্থ বালু। নামটি দিয়েছে ওমান। সম্ভাব্য এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে রাত থেকেই মহাবিপদ (১০ নম্বর) সংকেত দেখানো হতে পারে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া অফিসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছি ঘূর্ণিঝড়টি আসন্ন। আমরা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছি। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস পর্যালোচনা করে মনে হয়ছে, ঘূর্ণিঝড় আসন্ন, সেটা মাথায় রেখে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। রোববার ভোর থেকে এটা প্রাথমিক আঘাত হানতে পারে। এরপর সন্ধ্যা নাগাত মূলটা আঘাত হানবে।

প্রায় ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো এলাকা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সাত থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝড়ের সঙ্গে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর ভূমিধস হতে পারে। সব কিছু মাথায় রেখে সার্বিক প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে ৪ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত খাবার ও সরঞ্জাম রয়েছে। অতিরিক্ত প্রয়োজন হলে যেন ঢাকা থেকে সরবরাহ করা যায়, সেই প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরগুলোর উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে, সেইসঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।

কোস্ট গার্ড সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ক্রমান্বয়ে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণ, মৎস্যজীবী ও নৌযানসমূহকে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ কোস্টগার্ড উপকূলীয় অঞ্চলে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পটুয়াখালী জেলার বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের স্টেশন এবং আউটপোস্টসমূহ মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করছে। ঘূর্ণিঝড়ের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার জন্য নিকটবর্তী সাইক্লোন শেল্টার স্টেশনে আশ্রয় গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য সবাইকে সচেতন করা হয়েছে। কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের বিসিজি স্টেশন নিজামপুর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার আবু রাশেদ সুমন বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে দেশের সমুদ্র এলাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। পরবর্তীতে সংকেত বেড়ে ঘূর্ণিঝড় রিমালে রূপ নিয়ে উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এতে সংকেত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিতে সচেতনতামূলক মাইকিং শুরু করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে দুশ্চিন্তায় আছেন উপকূলের লাখো মানুষ।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সম্ভাব্য এই ঘূর্ণিঝড় রেমাল মোকাবিলায় নোয়াখালীর পাঁচ উপকূলীয় উপজেলায় ৪৬৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলে দুর্যোগকবলিতদের সহযোগিতার জন্য রেড ক্রিসেন্ট ও সিপিপির ৮ হাজার ৯১০ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে জরুরি সহায়তার জন্য ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা, ৩১৯ মেট্রিক টন চাল, ৬৬৩ প্যাকেট শিশুখাদ্য ও ৮ হাজার ২২০ কেজি গোখাদ্য মজুত আছে।

জানা গেছে, ১৮৯০ সালের দিকে মেঘনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছিল হাতিয়ার বহু জনপদ। পরবর্তী সময়ে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ভূমি ফিরিয়ে দিয়েছে মেঘনা। বর্তমানে মেঘনার চারপাশে অন্তত ৩০টি চর জেগে উঠেছে। এসব চরে হাজার হাজার একর জমি এখন দৃশ্যমান। যেখানে লক্ষাধিক মানুষজন বসবাস করেন। এরই মধ্যে বসতি গড়ে উঠেছে চরঘাসিয়া, ঢালচর ও চরআতউরসহ কয়েকটি চরে। চর মোহাম্মদ আলী, দমারচর, চরজোনাক, চরগাঙ্গুরিয়া, চর নুরুল ইসলাম, চর প্রিয়া ও চরওছখালীসহ কয়েকটি চরে ধান চাষের পাশাপাশি রয়েছে গরু, মহিষ ও ভেড়ার পাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরগুলো কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেলে নৌকা ও গাছে অবস্থান নিয়ে মানুষ রক্ষা পেলেও প্রাণহানি হয় পশুগুলোর। জোয়ারে প্লাবিত হওয়ায় একাধিকবার ধান চাষ করলেও ফলন মিলে একবার। নতুন জেগে উঠা এসব চরের একটিতেও নেই কোনো বেড়িবাঁধ। ফলে দুর্যোগের নাম শুনলেই আতঙ্কে থাকেন চরের মানুষ।

চরঘাসিয়ার বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম বলেন, দুর্যোগ এলে আমরা আতঙ্কে থাকি। চোখে ঘুম আসে না। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকি, মনে অজানা ভয় থাকে। চরের চারপাশে কোনো বাঁধ নেই। স্বাভাবিক জোয়ারেই চরে পানি উঠে, সেখানে ঘূর্ণিঝড় এলে সব ডুবে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত